হৃদয়নন্দন বনে-কুয়াশার চাদর ভেদ করে যখন আশার আলো দেখা দেয় by আলী যাকের

আজকাল খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মাঝে মধ্যে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি, ঘুম আসে না। তখন বিছানা ছাড়তেই হয়। গিয়ে বসি আমার পড়ার টেবিলে। আমার সামনেই বিশাল খোলা জানালা।
দেখি আকাশ, বাড়িঘর এবং কিছু দূরে দিগন্তের বনরেখা। গতকাল সকাল ভোর সাড়ে ৫টায় আমার পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। তখন অবশ্য ঘন কুয়াশা ব্যাপ্ত করে রেখেছে দিক দিগন্ত। খুব বেশি দূর অবধি দেখা যাচ্ছে না। অতএব, দৃষ্টি আমার সীমাবদ্ধ থাকে জানালার আলসেতে। সেখানে টবের মধ্যে ছোট ছোট অনেক গাছ আছে। নানারকম ফুলের গাছ। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় অপরাজিতা। প্রায় সারাবছরই নীল ফুলে ভরে থাকে এই ছোট্ট লতানো গাছটি। অপরাজিতা, অপরাজিতা, অপরাজিতা। এই কথাগুলো নিজেকেই নিজে যেন বলি বারবার। বলি এ কারণে যে, কৈশোর এবং যৌবনের সন্ধিক্ষণে প্রায় সব আপনজনকে হারিয়ে অনাথ হয়ে গেলেও কেবল পরাজিত হবো না, এই মনোবৃত্তি আমায় আমার মতো করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে অপরাজিতা প্রসঙ্গে আসছি পরে।
জানালার ধারে গিয়ে বসে যখন নানারকম চিন্তা, কিছু সংলগ্ন, কিছু অসংলগ্ন আমার মাথায় ভিড় করে আসছে, তখন হঠাৎ আমার প্রিয় চড়ূই পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হয়। ওরা রোজ সকালে এসে আমার জানালার আলসেতে বসে আমার সঙ্গে নানা কথা বলে। আমি যেন ওদের কিছু কিছু কথা বুঝতেও পারি। জানি, ওরা আমার কাছে কিছু খেতে চায়। আমার পড়ার টেবিলেই একটি ছোট বাটিতে কিছু চাল রাখা থাকে, আমি সেই চাল আলসের ওপরে ছড়িয়ে দিলে ওদের আনন্দ দেখে কে? ওরা হাসে, নাচে, একে অন্যের সঙ্গে খুনসুটি করে, ঝগড়া করে। আমি পাখিদের জীবনের সঙ্গে আমাদের জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পাই। ঠিক ওদেরই মতো কত অল্পতেই না পরিতৃপ্ত আমাদের সাধারণ মানুষ! অথচ ওদের জন্য এই অল্পের আয়োজনে আমাদের কেন এত অনীহা? সাধারণ মানুষ এই অল্পে সন্তুষ্ট বলেই আমরা করে খাচ্ছি। আমাদের যারা সমাজের, প্রশাসনের কিংবা রাজনীতির শীর্ষে আছে তারা নগরবাসী কতিপয় ঐশ্বর্যবান মানুষ বেছে নিয়ে তাদের তেলা মাথায় তেল দিতে এত আগ্রহী কারণ ওইসব মাথা থেকে অতিরিক্ত ছিটেফোঁটা তেলও যদি সাধারণ মানুষের মাঝে পড়ে, তাহলেই তো সাধারণ জনগণ ক্ষমতাসীনের পক্ষে এসে যায়? তবে আর প্রয়োজন কী জনে জনে জনতার খোঁজ রাখার? কিছু মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের প্রয়োজনের অধিক উপকরণে সমৃদ্ধ করে তোল, তারপর তারাই সব মানুষকে তোমার জন্য সুনিয়ন্ত্রিত রাখবে। এসব প্রায় অসংলগ্ন কথা চিন্তা করতে করতে আমার দৃষ্টি আবার গিয়ে পড়ে সেই অসাধারণ সুন্দর অপরাজিতা ফুলের দিকে। ভোরের সূর্য তখন পূর্ব দিগন্তে সম্পূর্ণ উদিত। আমি আবারও মনে মনে উচ্চারণ করি অপরাজিতা! অপরাজিতা!!
হঠাৎ করেই এই নৈসর্গিক প্রত্যুষের যে বিমূর্ত বোধ, সেখান থেকে মন ধেয়ে যায় অতি নিকট অতীতের দিকে। এই বছরের শেষে এসে বছরের সালতামামিতে বোধ করি সবচেয়ে শীর্ষে যে কয়েকটি নাম আসে তার মধ্যে অবশ্যই উঠে আসে আরেক অপরাজিতার নাম। মালালা ইউসুফজাই। কী পরম সাহসে অপ্রতুল বিত্ত নিয়ে ওই কিশোরী দুটি কোমল হাত এবং একটি ইস্পাতসম হৃদয়ের অস্ত্রে নির্ভর করে পাকিস্তানের মতো এক দুর্বৃত্ত অধ্যুষিত দেশে বিদ্রোহ করেছিল তালেবানের বিরুদ্ধে। তালেবানরা নারী শিক্ষাবিরোধী। কিন্তু হৃদয়ে প্রত্যয় যখন গভীর এবং মানুষটি যখন আপসহীন তখন কে ঠেকায় তাকে? মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে সে লেখাপড়ায় অগ্রণী হয়েছিল। তার এই দুঃসাহসের কারণে ওই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গুলিবর্ষণ করে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে। অল্পের জন্য বেঁচে যায় মালালা। বেঁচে যায় আমাদের এই সদ্য আবিষ্কৃত অপরাজিতা ফুল। ভোরের স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত যার নৈসর্গিক নীল। মালালা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ বৈকি।
বড় কষ্ট হয় যখন দেখি যে, আমার পরম ভালোবাসার ধন, আমার এই জন্মভূমি ক্লেদাক্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেই সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকেই। তারপর ক্রমেই আমরা যেন ডুবে যাচ্ছি পূতিগন্ধময় এক অন্ধকার জলাধারের অতলে। বীতশ্রদ্ধ হয়ে যাই আমার দেশের এই ক্রমাবনতি দেখে। কিন্তু এরই মধ্যে আশার আলো যে দেখি না আমরা তা-ও নয়। অনেক দুর্লভ সুকৃতি বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের গর্বিত করে এবং এই সুকৃতির জন্য কৃতিত্ব যাদের প্রাপ্য, সেসব মানুষ আমাদের মনে আশার সঞ্চার করেন। আমরা আবার বুকে বলভরসা খুঁজে পাই। এই ২০১২-তেই ঘটে গেছে একাধিক ঘটনা। রেকর্ডের বইয়ে নাম উঠেছে একাধিক মানুষের, যা আমাদের বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করে। তারই থেকে বেছে তুলে আনি হিমালয় বিজয়ের কাহিনী। আমাদেরই দুই তরুণ নিশাত এবং ওয়াসফিয়া এভারেস্ট জয় করে দেশে ফিরেছেন বিজয় মুকুট নিয়ে। এই গৌরবে আমরা সবাই ভুলে গেছি দেশের ভেতরে সংঘটিত নানা অপকর্মের কথা। যে দেশে এমন মানুষ আছে, যারা জয় করতে পারে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, সে দেশে আর কী চাই? কেবল এখানেই শেষ নয়। বিশ্বের সাতটি দুর্গম শৃঙ্গ জয় করার মানসে পা বাড়িয়েছেন ওয়াসফিয়া। এই গৌরব তো বাংলাদেশেরই।
সেখান থেকে দৃষ্টি ফেরাই আমাদের ক্রীড়াক্ষেত্রের দিকে। এযাবৎকালে সব খেলাধুলার মাঝে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা আমাদের চিরকালের। যখনই আমাদের দল কোনো সাফল্য অর্জন করেছে, গোটা বাংলাদেশের মানুষ একসঙ্গে হৈ হৈ করে উঠেছে। সব দুঃখতাপ, রোগ, জরা ভুলে তারা রাস্তায় নেমে এসেছে নিজ দেশের দলকে সাধুবাদ জানাতে। কিন্তু এই কৃতিত্বের মাঝেও হঠাৎ করেই কেমন যেন আশাহত হয়ে পড়েছি আমরা। যেন সবসময় ভরসা রাখতে পারি না। এই ভালো তো এই খারাপ। এভাবেই ভালোমন্দের সংমিশ্রণে খেলাটি এগিয়ে চলেছিল। ভাবতাম, আমাদের জীবদ্দশায় কি আমরা আদৌ দেখে যেতে পারব একটি শক্তপোক্ত দল, যারা হেরে গেলেও লড়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত থাকবে? সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সীমিত ওভারের খেলায় বাংলাদেশ দলের শরীর-মনের ভাষা দেখে মনে হয়েছে যেন আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে পেরেছি। এক সময় যখন মমিনুল ব্যাট করছিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের শক্তিশালী দ্রুতগতির বোলার রোজ এবং রাসেলের বিরুদ্ধে, তখন আতঙ্কে ছিলাম। ক্ষুদ্রকায় মমিনুলকে বিরাটাকৃতি বোলারদের বিরুদ্ধে মনে হচ্ছিল ভীষণ নিঃসহায়। কিন্তু কী দাপটের সঙ্গে তিনি ওই বোলারদের অবলীলায় পুল এবং হুক শট খেলে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের অন্য কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়রাও লড়ে গেছেন এবং সিরিজ বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন বাংলাদেশের জন্য।
গতকাল সকালে এ ধরনের ভালোমন্দ, আনন্দ-শঙ্কায় যখন মনে মিশ্র এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তখন রৌদ্রস্নাত আমার জানালার আলসেতে ছোট ছোট ফুল গাছগুলোর ওপর অবলীলায় খেলে চলেছে চড়ূইয়ের দল। কোনো চিন্তাই নেই তাদের। আমি ওদের ভোগ হিসেবে আরও কিছু চাল ছড়িয়ে দিই। ওদের কলকাকলিতে আমার মনটা আবার শঙ্কামুক্ত হয়ে এক সুখী ভবিষ্যতের আশার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক কর্মী

No comments

Powered by Blogger.