বিশ্বজিৎ হত্যাঃ পরিবার ও নেতারাও বলছেন, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী

অবরোধের সময় বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্তরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। তাঁদের কয়েকজনের পরিবার ও এলাকাবাসী এবং ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এর আগে দাবি করেছেন, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী নন।

এদিকে এই হত্যার ঘটনায় গতকাল শুক্রবার রাতে সিলেট থেকে রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন ও ঢাকা থেকে সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান এ খবর নিশ্চিত করেন। শাওনের সঙ্গে উৎপল নামের এক যুবককেও আটক করা হয়।
জানা গেছে, বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এইচ এম কিবরিয়ার পুরো পরিবারই আওয়ামী লীগের সমর্থক। গ্রেপ্তার কাইয়ুম মিয়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী। রাজন তালুকদারের ধারালো অস্ত্রের আঘাতেই বিশ্বজিৎ বেশি আহত হন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারাই। রাজন পুরো এলাকায়ই ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত।
কিবরিয়ার গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার চেংগুটিয়ায়। তাঁর বাবা আতিকুর রহমান হাওলাদার সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট কর্মকর্তা। গতকাল গ্রামের বাড়িতে গেলে কিবরিয়ার বাবা প্রথম আলোকে বলেন, আগে কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করেন কিবরিয়া। কিবরিয়ার বড় ভাই আসাদুজ্জামান শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক।
রাজনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার কেশবপুর গ্রামে। কলমান্দার স্থানীয় একটি স্কুলে এসএসসি ও ময়মনসিংহের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। গতকাল গ্রামের লোকজন জানান, রাজন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। এলাকায়ও দলের মিছিল-মিটিংয়ে তিনি অংশ নেন।
রাজনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ও হোমিও চিকিৎসক সুসেন চন্দ্র তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজন ছাত্রলীগের রাজনীতি করে। সে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়কের (সাবেক) কাছাকাছি থাকে বলে জানিয়েছে। গত মঙ্গলবারের পর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।’
একই কথা বলল গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুলের পরিবার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র সাইফুলের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চন্দনাবাড়ীর পূর্বপাড়ায়। বৃহস্পতিবার সেখানে গেলে সাইফুলের মা হেলেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পোলা এই খুনের লগে থাকলে এর বিচার তো আমি আটকাইয়া রাখতে পারোম না।’ তিনি দাবি করেন, এক সপ্তাহ ধরে ছেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই।
সাইফুলের এলাকার সহপাঠীরা প্রথম আলোকে বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সাইফুল ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। দলীয় প্রভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংদী ছাত্রকল্যাণ ঐক্য পরিষদের সভাপতি হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে জায়গা করে নিতে তিনি রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন।
রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওনের গ্রামের বাড়ি খুলনার পাইকগাছার নাছিরপুর গ্রামে। বাবা লুৎফর রহমান। জানা গেছে, বুধবার তিনি বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গণমাধ্যমে নাম-ছবি আসার পর তিনি গা ঢাকা দেন।
লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলেডা ভালো ছিল, গ্রামে কোনো দল করত না। ঢাকায় যাওয়ার পরে ছাত্রলীগ করা শুরু করল। তখন আমি অনেকবার ওকে মিছিল-মিটিংয়ে যাতি নিষেধ করেছি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুনের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার খলিলপুর সরদারপাড়ায়। বাবা সাদেকুল ইসলাম একটি মাদ্রাসার সুপার। আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা বলেন, মামুনকে তাঁরা ঢাকার ছাত্রলীগের একজন বড় নেতা হিসেবেই জানেন। সাদেকুল ইসলাম বলেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ তাঁকে ভালোভাবেই চেনেন। নির্বাচনের সময় ওই সাংসদের পক্ষে তিনি প্রচারণা চালিয়েছেন।
চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিৎকে কুপিয়েছেন রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল। তাঁর বাবা আনসার মিয়া পটুয়াখালী কর বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। আনসার মিয়া বলেন, ‘পটুয়াখালীতে থাকার সময় শাকিলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। ঢাকায় রাজনীতিতে জড়িয়ে সে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে।’
শাকিলের বড় ভাই শাহিন মিয়া পটুয়াখালীতে যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান আনসার।
আরেক অভিযুক্ত মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদের বাড়ি ভোলার দৌলতখান উপজেলার দক্ষিণ জয়নগর ইউনিয়নের খায়েরহাটে। বাবা মাওলানা আবদুর রহমান দক্ষিণ জয়নগর হোসাইনিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে খায়েরহাট বাজার জামে মসজিদে ইমামতি করছেন। মাহফুজ ওই মাদ্রাসা থেকেই ২০০১ সালে দাখিল ও আলিম পাস করেন। বড় ভাই মাকসুদুর রহমান একটি দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক।
আরেক অভিযুক্ত ইমদাদুল হকের বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলার পাঁচকায়বা গ্রামে। বছর তিনেক আগে মারা গেছেন বাবা আকরাম আলী। ছোট ভাই জাকির হোসেন ভ্যান চালিয়ে ও দিনমজুরি করে সংসার চালান।
ইমদাদের চাচা শাহজাহান আলী শার্শা উপজেলার সামটা সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক। ইমদাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি তার খোঁজখবর রাখিনে। বাড়িতে সে কখন আসে কখন যায়, আমি বুঝতে পারিনে। তার হাবভাবে যতটুকু বুঝেছি, সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।’
মীর মো. নূরে আলম ওরফে লিমন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ী ইউনিয়নের শুল্লিপাড়া গ্রামের মীর মো. নুরুল ইসলামের ছেলে। নুরুল ইসলাম বংশানুক্রমে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে তিনি জানান। আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িত যাঁদের নাম-ছবি গণমাধ্যমে এসেছে এবং যাঁদের ডিবি গ্রেপ্তার করেছে, তাঁরা প্রত্যেকেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েকটি পক্ষের কর্মী। মাহফুজ ও ইমদাদুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরীফুল ইসলামের কর্মী। শাকিল, রাজন, শাওন, সাইফুল, উজ্জ্বল, কিবরিয়া ও কাইয়ুম সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের পক্ষের কর্মী। তাঁদের অধিকাংশই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপনাট্য ও বিতর্ক সম্পাদক জহির উদ্দিন ওরফে বাবরের পক্ষের কর্মী ছিলেন।
জানতে চাইলে শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্তরা তাঁদের বন্ধুদের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রলীগে ঢুকেছিলেন। বর্তমান কমিটির সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা নেই। সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযুক্ত অনেকেই বাবরের লোক ছিল। আমি তাদের চিনি না।’
যোগাযোগ করা হলে জহির উদ্দিন বলেন, ‘হামলাকারীদের আমি চিনি। তবে তাঁরা আমার কর্মী ছিলেন না।’
আট দিনের রিমান্ডে: আমাদের আদালত প্রতিবেদক জানান, বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় ডিবির হাতে গ্রেপ্তার মাহফুজ, কাইয়ুম ও কিবরিয়াকে আট দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম শাহারিয়ার মাহমুদ আদনান এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে কাইয়ুম ও কিবরিয়ার জামিনের আবেদন নাকচ করেন আদালত।
গতকাল সূত্রাপুর থানার পুলিশ তিনজনকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে গতকাল সূত্রাপুর থানার ওসি নজরুল ইসলামকে মহানগর পুলিশের ট্রেনিং একাডেমিতে বদলি করা হয়েছে। সূত্রাপুর থানার ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হাজারীবাগ থানার ওসি রফিকুল ইসলামকে। উপকমিশনার মাসুদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন গৌরনদী, পটুয়াখালী, ভোলা, যশোর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, খুলনা, পীরগাছা ও পার্বতীপুর প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.