সরকার পরিবর্তন হলেই বেড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা! by শরিফুজ্জামান

দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৮০০। ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে জাতীয় তালিকায় (গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি) সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮। এই হিসাবে ১৯৮৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট/ ভারতীয় তালিকা) মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। সেই তুলনায় এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ।
১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার-সূচক তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার। আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) সবুজ মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় এক লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। সেখান থেকে বাছাই করে ২৭ হাজার ৫৪৮ জনকে বাদ দিয়ে লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশ করা হয় এক লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের তালিকা। এর ফলে বিএনপি সরকারের সময়ের (১৯৯৪) তুলনায় আওয়ামী লীগের সময় সংখ্যা বাড়ে ৯৬ হাজার।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯৮ হাজার ৫২৬। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনায় জোটের তালিকায় নতুন অন্তর্ভুক্ত হয় ৪৪ হাজার ৭৪ জন। বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদে নতুন তালিকাভুক্ত হয়েছে ছয় হাজার ২৭৪ জন।
দেখা গেছে, সরকার পরিবর্তন হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এ পর্যন্ত পাঁচটি তালিকা হয়েছে। তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদে বস্তাবন্দী হয়ে আছে আরও প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার আবেদন।
ভুয়ার সংখ্যা কত?: গত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে মুক্তিবার্তার তালিকা ও জোট সরকারের গেজেট—এ দুটি যোগ করলে মুক্তিযোদ্ধার মোট সংখ্যা হয় তিন লাখ ৫২ হাজার ৯৭৬। তবে ওই মুক্তিবার্তা ও গেজেটে একই নাম রয়েছে এক লাখ নয় হাজার ৬৫৪ জনের। মুক্তিবার্তায় আছে গেজেটে নেই—এমন সংখ্যা প্রায় ৪৪ হাজার; আবার গেজেটে আছে মুক্তিবার্তায় নেই এমন সংখ্যা ৪৩ হাজার ৭৭৭। এই সংখ্যা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, সরকারের গেজেটে ৪৩ থেকে ৪৫ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম ঢুকেছে।
এ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকার ৭০ হাজার ৮৯২ জন নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তাই বর্তমান গেজেটে থাকা দুই লাখ চার হাজার ৮০০ জনের তালিকা থেকে এ সংখ্যাটি বাদ দিলে থাকে এক লাখ ৩৪ হাজার আটজন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান হেলাল মোর্শেদ খান বলেন, এই সংখ্যার মধ্যেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করতে হবে এবং সেই সংখ্যাটি ৪৩ থেকে ৪৫ হাজার হতে পারে। তবে ২০০৯ সালের এপ্রিলে জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭২ হাজার।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে হেলাল মোর্শেদ বলেন, তালিকায় ঢোকানো সহজ, কিন্তু কেউ একবার তালিকাভুক্ত হলে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে বাদ দেওয়া কঠিন। ইতিমধ্যে সরকারের সিদ্ধান্তে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করায় সারা দেশে ৩০টির মতো মামলা হয়েছে।
এখানেও প্রভাবশালীরা: বর্তমান সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালিকাভুক্ত না হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে। আবেদন পড়ে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার। আড়াই বছর ধরে সেগুলো পড়ে আছে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অবস্থান হচ্ছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দেওয়ার আগে নতুন তালিকা করা হবে না। তবে মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ ঠিকই দিচ্ছে। এঁদের প্রায় সবাই সচিবসহ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সাংসদ এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। পড়ে আছে সাধারণ মানুষের আবেদনগুলো।
কয়েকটি সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স বাড়ানোয় কয়েকজন সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকে সনদ সংগ্রহে লেগে পড়েন। এ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা ছিল না। এখন প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পেতে যাচ্ছেন। চাকরির বয়স বাড়ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা চাকরি ও ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এসব কারণে এ সনদ অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মানুষের তৈরি এ তালিকায় ভুলত্রুটি হতে পারে। তবে ধরা পড়লে তা অবশ্যই সংশোধন করা হবে।
বিতর্কে তথ্যভান্ডার: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইটে এক লাখ ৭৬ হাজার ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করতে যাচ্ছে। সর্বজনগ্রাহ্য তালিকা তৈরির আগে এ রকম তথ্যভান্ডার তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বৈধতা দিতে ভূমিকা রাখবে তথ্যভান্ডার। তাঁদের অভিমত, আগের পাঁচটি তালিকার মধ্যে দুটিতে যাঁদের নাম আছে, তাঁদের বৈধ হিসেবে ধরে নেওয়া হোক। কিন্তু তথ্যভান্ডার হওয়ার পর আগের পাঁচটি তালিকার একটিতে এবং তথ্যভান্ডারে নাম থাকলেই যে কেউ বৈধতার স্বীকৃতি পাবেন। তখন ভুয়া খুঁজে বের করা কঠিন হবে।
জামুকার কাগুজে উপদেষ্টা পরিষদ: গঠনের তিন বছর চার মাসের মধ্যে একটিও সভা হয়নি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) উপদেষ্টা পরিষদের। অথচ বছরে অন্তত একটি সভা করার বিধান রয়েছে। সাত সদস্যের ওই কাউন্সিলের প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টাসহ ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিক আছেন সদস্য।
পরিষদের অন্যতম সদস্য, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট পরিষদ গঠনের পর কোনো সভা হয়নি। এ বিষয়ে মন্তব্য করারও কিছু নেই।’
২০০২ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে জামুকা গঠিত হয়। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এর উপদেষ্টা পরিষদ ও ৪ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কাউন্সিল কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কমিটির আটজন সদস্যই সাংসদ। আইনে আছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের ব্রিগেড কমান্ডার, সেক্টর কমান্ডার, সাব-সেক্টর কমান্ডার অথবা উল্লিখিত কমান্ডসমূহের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক কর্মকাণ্ডের সহিত সংশ্লিষ্টদের মধ্য হইতে আটজন ব্যক্তি, যাহারা প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক মনোনীত হইবেন’ তাঁদের সদস্য করার কথা।
কাউন্সিল শক্তিশালী করতে একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এ জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। কাউন্সিলের কাজকর্ম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করতেই তাদের মনোযোগ বেশি।

No comments

Powered by Blogger.