বাংলাদেশি শিশুকে অক্ষত উদ্ধার, স্যান্ডিহুকে বাঙ্গালীদের মধ্যে আতঙ্ক by শিহাবুদ্দীন কিসলু ও সাবেদ সাথী

যুক্তরাষ্টের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের নিউটাউনে স্যান্ডি হুক প্রাক-প্রাথমিক স্কুল থেকে একটি বাংলাদেশি শিশুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশি এ শিশুকে উদ্ধারের পর কানেকটিকাটে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে নিকট আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবরা ফোন করে তাদের প্রিয় সন্তানদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। স্খানীয় সময় শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় স্যান্ডি হুক প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে এক উন্মত্ত বন্দুকধারীর গুলিতে ২০ শিশুসহ ২৮ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে হামলাকারী ও তার মা-ও রয়েছে।

কানেকটিকাটের নিউটাউনে বাংলাদেশিদের বসবাস তেমন একটা নেই। মাত্র ৭টি পরিবারের বাস। সেখানে তারা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। এর মধ্যে স্যান্ডি হুক এলাকায় রয়েছে মাত্র ২টি পরিবার। এরা হলেন মাহবুব আহমেদ ও মাহবুব হোসেন। মাহবুব আহমেদের ৬ বছরের ছেলে মামনুন আহমেদ স্যান্ডি হুক প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের প্রথম গ্রেডের ছাত্র।

স্কুলটিতে বন্দুকধারির গুলিবর্ষণ ও মর্মান্তিক এ র্ঘটনা প্রসঙ্গে মাহবুব আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন তিনি নিজেই গাড়িতে করে তার ছেলেকে স্কুলে রেখে আসেন। কিন্ত গত শুক্রবার কাজে ব্যস্ততার কারণে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাসে করে ছেলেকে পাঠিয়েছেন। ওইদিন স্যান্ডি হুক প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে প্যারেন্টস ডে`র আয়োজন করা হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট সময়ে সব অভিভাবকের সেখানে উপস্থিত হবার কথা ছিল। এর আগেই সকাল পৌনে ১০টায় তিনি স্কুল থেকে একটি ফোনকল পান। স্কুলে কর্মরত শিক্ষকরা তাকে ফোনে জানান যে, একটু আগে অজ্ঞাত এক বন্দুকধারি স্কুলে গুলিবর্ষণ করেছে। আপনার সন্তানকে সাহায্য করার জন্য এক্ষুনি স্কুলে চলে আসেন। তিনি তার ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকায় তার স্ত্রীকে সাঈদা আহমেদকে স্কুকে পাঠিয়ে দেন। তিনি পুলিশদের হেফাজতে দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর নিরাপদের তার প্রিয় সন্তানকে নিজের কোলে ফিরে পান। মা সাঈদা বাংলানিউজকে জানান, এ সময় তিনি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান।
মাহবুব আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, তার বড় ছেলে পার্শ্ববর্তী মিডল স্কুলের ছাত্র। একই স্কুলে স্যান্ডি হুক এলাকার অপর বাংলাদেশি মাহবুব হোসেনের ছেলেও পড়াশোনা করে। এদিকে নিকটস্থ শহর নিউটাউনের বাংলাদেশি আজাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এই জঘন্যতম ঘটনায় শুধু কানেকটিকাটের বাংলাদেশিরাই নয়, গোটা আমেরিকায় সকল অভিভাবকই আতংকিত ও হতবাক।

স্কুলে শুটিংয়ের ঘটনা এর আগেও অনেক হয়েছে কিন্তু এমন জঘন্য ঘটনার কথা কখনও শোনা যায়নি।

নিউটাউনের পার্শ্ববর্তী ড্যানবুরিতে রয়েছে শতাধিক বাংলাদেশি পরিবার। সেখানকার সকল বাংলাদেশি অভিভাবকই তাদের সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কে আছেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সাবেক ছাত্রনেতা হেলালুল করিম দীর্ঘদিন ধরে ড্যানবুরিতে বাস করছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন,কয়েক বছর আগেও কানেকটিকাটে এমন অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড ছিল না। সম্প্রতি এর মাত্রা অনেকাংশে বেড়েছে। চলতি বছরেই কানেকটিকাটে পরপর তিনজন বাংলাদেশি দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সেই আতংক এখন বাংলাদেশিদের মাঝে বিরাজ করছে। তারপর গত শুক্রবারের স্যান্ডি হুক প্রাথমিক স্কুলে বন্দুকধারির গুলিবর্ষণের ঘটনা আমাদের আরও আতংকিত করে তুলেছে। এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকলে বাংলাদেশিরা কানেকটিকাট ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে। তাই আমরা বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারি সংস্থাকে এ বিষয়ে সজাগ থাকার জন্য আহবান জানান। 

শুক্রবার বন্দুকহাতে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে প্রায় একশ রাউন্ড গুলি ছোড়ে ওই বন্দুকধারী। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ২০ শিশুসহ মোট ২৮ জন। আহত হয়েছে আরও অনেকে। পার্শ্ববর্তী ডানবেরী হাসপাতালের মুখপাত্র জানিয়েছে হাসপাতালে ৩ জনের চিকিৎসা চলছে ।

প্রত্যক্ষদর্শী এক অভিবাবক জানান, বন্দুকধারীর গুলিতে ওই স্কুলের অধ্যক্ষ ও মনোচিকিৎসক মারা গেছেন।
ওই অঙ্গরাজ্যের পুলিশের মুখপাত্র লে. পল বেন্স জানান, এ পর্যন্ত ২১ প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীসহ ২৮ জনের মৃত্যুর খবর তারা পেয়েছে। বাকি ৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোক ও একজন হামলাকারী নিজে। এর মধ্যে ওই স্কুলের কয়েকজন কর্মকর্তাও রয়েছেন। এছাড়া একজন শিক্ষক গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সিবিএস নিউজকে জানান, ২০ বছর বয়সী ওই হামলাকারীর নাম রায়ান লানজা। তিনি এডাম লানজার বড় ভাই। তার মা ওই স্কুলের শিক্ষকতা করতেন।

বেন্স আরও জানান, হামলাকারীর মৃতদেহ স্কুলের ভেতরে পাওয়া গেছে। তবে তিনি কিভাবে মারা গেলেন তা জানাতে পারেনি।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, লানজার মা ওই স্কুলে কাজ করতো এবং মারা যাওয়াদের মধ্যে একজন। মূলত লানজার লক্ষ্য ছিল তার মা। লে. পল বেন্স জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৮ শিশু ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং তিনজন মারা যায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে। নিহতদের শরীরে আলাদা কোনো আঘাতের চিহৃ পাওয়া যায়নি।
সিবিএস নিউজে বলা হয়, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৩টি বন্দুক উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে একটি টু-টোয়েন্টি থ্রি পিস্তল, একটি গ্লোক ও একটি সিগ সয়ার পিস্তল রয়েছে। এছাড়া তার গাড়িতে একটি রাইফেলও পাওয়া গেছে।

এটি কানেকটিকাটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং দেশটির ইতিহাসে দ্বিতীয় স্কুল-হত্যাকাণ্ড। এর আগে ২০০৭ সালে শুধুমাত্র ভার্জিনিয়া টেক এ ৩৩ জনকে করা হয়েছিল। তারও আগে ১৯৯৯ সালে কলম্বিয়ান হাইস্কুলে বন্দুকধারীদের গুলিতে শিক্ষকসহ ১২ জন ছাত্র-ছাত্রী নিহত হয়েছিলো।

কানেকটিকাটের গভর্নর ড্যানিয়েল মেলয়সহ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস প্রতিক্রিয়ায় এ ঘটনাকে “সেন্সলেস, টেরিফায়েড ট্রাজেডি ” বলেছে । যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের স্পিকার জন বনার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন । তিনি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় গভীর দুঃখপ্রকাশ করে বলেছেন, “যে কোনো সহযোগিতার জন্য আমরা পাশে আছি ।”

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এফবিআইএ’র পরিচালক রবার্ট মুলারের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন । রবার্ট মুলার নিজেই নিউটাউন স্যান্ডিহুক স্কুল পরির্দন করেছেন । প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, রাজনীতি নির্বিশেষে এধরনের ট্রাজেডি এড়াতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ।
স্যান্ডিহুক স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষক মিসেস কেরি আশার জানিয়েছেন, তারা শিক্ষকদের কক্ষে মিটিংয়ের সময় স্কুলের মাইকে কিছু একটা ঘোষণা শুনতে পান । সম্ভবত, স্কুলের প্রিন্সিপাল ঘোষণাটি দিয়েছিলেন মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ।
হত্যাযজ্ঞের কারণ এখনও উদঘাটন হয়নি । নিউটাউন স্যান্ডিহুক স্কুলে মোট শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৫৭৫ জন । আর  নিউইয়র্ক শহরের ৬৫ মাইল উত্তরপূর্বে অবস্থিত নিউটাউনের মোট অধিবাসী রয়েছে ২৮ হাজার । স্যান্ডিহুক স্কুলের রম্বা হলরুম সাদৃশ্য এলিমেন্টারি ক্লাসে ৪৫ জন শিক্ষার্থী ছিল ।

No comments

Powered by Blogger.