আইএমএফের ঋণের কিস্তি পাওয়া অনিশ্চিত- পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে চায় সরকার by ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ এড়িয়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে চাইছে সরকার। আবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ। এ কথাও মানছে না সরকার।


এ কারণে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
আইএমএফের শর্ত মেনেই ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর সংশোধনের কাজ এখন চলছে। এ আইন সংশোধন করে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের সার্বিক বিনিয়োগের পরিমাণ মোট পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশে সীমিত রাখতে বলেছিল আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংকও একই কথা বলেছিল। কিন্তু তাদের কথা আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য তৈরি হওয়া সংশোধিত আইনের খসড়ায় পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশের প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। খসড়ায় অবশ্য বলা হয়েছে, সরকার চাইলে যেকোনো সময় তা কমাতে পারবে, কোনো অবস্থাতেই বাড়াতে পারবে না। বর্তমানে ব্যাংকগুলো তাদের মোট আমানতের ১০ শতাংশ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে।
নির্বাচনের আগে পুঁজিবাজার চাঙা করতেই এ উদ্যোগ বলে জানা গেছে। তবে এতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বাড়বে। তা ছাড়া কৃত্রিমভাবে শেয়ারবাজার চাঙা করার ফল অতীতে কখনোই ভালো হয়নি বলে বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
খসড়াটি তৈরি করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এতে সায় দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলেছে, ব্যাংক খাতের ঝুঁকি কমিয়ে আনার পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করাই হলো তাদের উদ্দেশ্য। আর সে জন্যই তারা ৪০ শতাংশের পক্ষে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এসব বিষয়ে এরই মধ্যে আইএমএফ অবগত হয়েছে। সংস্থাটি তাদের আপত্তির কথাগুলোও জানিয়ে দিয়েছে। বলেছে, শর্ত পরিপালিত না হলে বাজেট-সহায়তা বাবদ বর্ধিত ঋণ-সহায়তার (ইসিএফ) দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আনার শর্তটি আইএমএফের একটি ভালো শর্ত। এটি হওয়া উচিত।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধিত) আইন, ২০১২-এর খসড়া তৈরি করতে গত মার্চে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সাবেক সচিব এ কে আবদুল মুবিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই কমিটির সদস্যরা হলেন: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অমলেন্দু মুখার্জি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস এম মনিরুজ্জামান, এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক এ কে এম নুরুল ফজল ও আইনজীবী সরদার জিন্নাত আলী। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব রিজওয়ানুল হুদা কমিটির সদস্যসচিব। এই কমিটির সুপারিশও মানছে না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক: ব্যাংক কোম্পানি আইনের জন্য আবদুল মুবিন কমিটিতে আলাদা করে কিছু সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে খসড়ায় তা আমলে নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে আদায়কৃত মূলধনের ১০ শতাংশ। তবে সব মিলিয়ে হিসাব করলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ হতে পারবে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ।’ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংক যেসব শেয়ার, বন্ড, ঋণপত্র, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি ধারণ করে, সেগুলোর বাজারমূল্য; পুঁজিবাজার কার্যক্রমে জড়িত ব্যাংকের সহযোগী (সাবসিডিয়ারি) কোম্পানিগুলোতে যে অর্থ বিনিয়োগ করে; ব্যাংকের দেওয়া ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণসুবিধা (ব্রোকার হাউসগুলোকে ঋণ দেওয়া) এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য গঠিত কোনো তহবিলে চাঁদা দেওয়া—সবই আসবে ২৫ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ সমস্টিগতভাবে আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি এবং ধরে রাখা আয়ের মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশের বেশি হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কথাগুলো সব ঠিক রেখে খসড়ায় শুধু পরিমাণটি বাড়িয়ে ৪০ শতাংশের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের টাকা আমানতকারীদের। এই টাকা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কম বিনিয়োগ হওয়াই ভালো। অন্যান্য দেশের চর্চা মেনেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফ ২৫ শতাংশের কথা বলেছে। তাই জোর করে ৪০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া একদমই ঠিক হবে না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা করতেই হবে।’
ব্যাংকের পরিচালক হবেন ১৫ জন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), একজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫ জন হবে বলে খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে বর্তমানে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ব্যাংক কোম্পানি অধ্যাদেশ পাস হলেও নানামুখী চাপে বর্তমান সরকার তা বাতিল করে দেয়। অধ্যাদেশে ব্যাংক কোম্পানিতে ১৩ জন পরিচালক রাখার কথা বলা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এ-বিষয়ক একটি প্রজ্ঞাপনেও ১৩ জনের কথাই বলা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকসহ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক তা মেনে আসছে।
ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি) পরিচালকদের সংখ্যা বাড়ানোর তদবির করে আসছে বলে জানা গেছে।
সমবায় সমিতি পরিদর্শন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক: সদস্য ছাড়া অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত নিতে পারবে না কোনো সমবায় সমিতি। কার্যক্রম খতিয়ে দেখার পাশাপাশি নিয়মের বাইরে আমানত নিলেই গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বর্তমানে কোনো সমবায় সমিতির পরে ‘ব্যাংক’ শব্দটি লেখা থাকলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ছাড়া কোনো তদারকি বা নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই।
আবদুল মুবিন কমিটি বলেছে, সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিয়ে অবৈধ ব্যাংকিং করায় ছয় মাস ধরে কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। আইনটি সংশোধিত হলে সমবায়ের নামে কেউ আর অবৈধ ব্যাংকিং করতে পারবে না।
আংশিক ইসলামি ব্যাংকিং নয়: আংশিক ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সুযোগ আইনে রাখা হচ্ছে না। সংশোধনের পর তা কার্যকর হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী দুই বছর মেয়াদ পার হওয়ার পর ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংক ইসলামি পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনো ব্যবসাকেন্দ্র, শাখা কিংবা বুথ যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, পরিচালনা করতে পারবে না।
যেসব ব্যাংক কেন্দ্রীয়ভাবে ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত হয় না, কিন্তু সেগুলোর শাখা বা বুথ ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত হয়, তাদের কার্যাবলি শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালনা করা কঠিন হয়। খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের আংশিক কার্যক্রম ইসলামি শরিয়াহর অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
উদ্বৃত্তপত্র পত্রিকা ও ওয়েবসাইটে: দেশের বাইরে ও দেশের ভেতরে নিবন্ধিত ব্যাংকের প্রতিবছরের নিরীক্ষিত উদ্বৃত্তপত্র (ব্যালান্সশিট) ও লাভক্ষতির হিসাব ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আনা হচ্ছে আইনে।
বলা হয়েছে, ব্যাংকের আমানতকারী, শেয়ারহোল্ডার, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সবাই যাতে সহজে তথ্য পেতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিলের এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত একটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশ করতে হবে।
এ ছাড়া কোনো ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে সর্বনিম্ন ২০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে। যদি আইনের লঙ্ঘন ঘটতে থাকে, তা হলে লঙ্ঘনের প্রথম দিনের পর থেকে প্রতিদিনের জন্য ৫০ হাজার টাকা বাড়তি জরিমানা গুনতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.