মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন গোলাম আযম- যুদ্ধাপরাধী বিচার - সুলতানা কামালের জবানবন্দী

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তৃতীয় সাক্ষী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল জবানবন্দী প্রদান করেছেন।


আংশিক জবানবন্দীতে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন, তেমনি গোলাম আযম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষগুলোর প্রতীক। আল বদর, আল শামস ও রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি এসব বাহিনীর নেতা ছিলেন। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই কথা বলেন। একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে তৃতীয় সাফাই সাক্ষী নুরুল হক হাওলাদার জবানবন্দী প্রদান করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল দুই ঘণ্টা ধরে জবানবন্দী প্রদান করেছেন। আজ আবার অসমাপ্ত জবানবন্দী প্রদান করবেন। জবানবন্দী প্রদান করার সময় ট্রাইব্যুনাল-১ এর এজলাসে পিনপতন নীরবতা লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘ দু’ঘণ্টা ধরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা প্রদান করেন। জবানবন্দী প্রদান করার সময় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম তাঁকে সহায়তা করেন। এ সময় চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্যান্য প্রসিকিউটর উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ অন্যান্য আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
জবানবন্দীতে এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এরপর কিছু ‘কিলার ফোর্স’ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। আল বদর, আল শামস ছিল এ ধরনের বাহিনী। জামায়াতের ছাত্র ও তরুণ কর্মীদের নিয়ে এই বাহিনীগুলো তৈরি করা হতো। সব ক্ষেত্রে দলগুলোর সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে গোলাম আযমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি জেনারেল টিক্কা খানের মতো তৎকালীন পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাও গোলাম আযমের নাম ধরে প্রশংসা করেছেন। এ ছাড়াও মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আব্ব্সা আলী খানের নামও ঘুরেফিরে এসেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোলাম আযম প্রায়ই টিক্কা খান ও পাকিস্তানের অন্যান্য নেতার সঙ্গে মিলিত হতেন এবং পাকিস্তানের অখ-তা কিভাবে রক্ষা করা যায়, সেই পরিকল্পনা করতেন। সেই সময়ে হিন্দু ও খ্রীস্টানদের অবস্থা কি ছিল তা জেনেছি। প্রাণ রক্ষার্থে তাদের দেশের ভিতরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালাতে হয়েছে। ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তাদের শুধু ধর্মের কারণে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে এবং আরও অনেক ঘটনা শুনেছি যে, তাদের সমস্ত সম্পত্তি ফেলে শুধু জান বাঁচানোর জন্য দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। চার্চের মধ্যে ঢুকেও হত্যা করা হয়েছে। মন্দির ও ধ্বংস করা হয়েছে। শুধু ধর্মীয় কারণে তাদের এই হত্যাকা- ও অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
জবানবন্দীর শুরুতে মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আমার নাম সুলতানা কামাল, বয়স-৬৩, মায়ের নাম বেগম সুফিয়া কামাল। আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং ১৮৩৮। আমি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হই। ১৯৬৯ সালে অনার্স শেষ করি। এরপর ১৯৭৩ সালে এমএ পাস করি। এটা হয়ত সবারই জানার কথা আমার মা সুফিয়া কামাল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন, তার ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল তা অনেক কাছ থেকে আগ্রহের সঙ্গে দেখার সুযোগ হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল বলেন, ১৯৬৯ সালে আমার মা মহিলা সংগ্রাম পরিষদ করে মহিলা নেতৃত্ব গড়ে তোলেন। যারা মূল ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন। যখন থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আমরা সাংগঠনিকভাবে অংশ নিয়েছি। এছাড়া ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও উপস্থিত হই। ২৫ মার্চ রাত ১২টার দিকে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোন করে আমাদের কাছে ঢাকার অবস্থা জানতে চান। অবস্থা বেশি ভাল নয়Ñ এ টুকু বলার পর লাইন কেটে যায়। এ সময় আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ৪/৫টি বাড়ির পর আমাদের বাড়ি ছিল। সেখান থেকে আমরা মেশিন গান ও কামানের গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমাদের পাশের দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা আগুনের গোলা দেখা যাচ্ছিল। আমাদের বাড়ির সামনে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির ওপরে কালো পতাকা উড়ছিল। সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের বাড়ির সামনে লেকের ব্রিজের ওপর একজনকে গুলি করে মারা হয়েছে। পরে জানতে পারি বিখ্যাত সানা উল্লাহ সাহেবের ছেলে সম্ভবত তার নাম খোকন ছিল।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল আরও বলেন, এরপর আমরা এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ শুনতে পাই যা রাতভর চলছিল। পিলখানায় গুলির শব্দ স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেন, ২৭ মার্চ সকালে প্রচার করা হয় কারফিউ দেয়া হয়েছে ঘর থেকে কেউ বের হবে না। ওই দিন কিছু সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। আমরা তখন রাস্তায় বের হয়ে দেখার চেষ্টা করি। আমাদের বাড়িতে সাংবাদিকসহ রাজনৈতিক নেতারা ভিড় করেন।
তিনি বলেন, প্রফেসর মনিরুজ্জামান, ড. জিসি দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অনেক শিক্ষক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ তাদের হত্যা করার জন্য খোঁজা হচ্ছে। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইকবাল হলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মধুদা ছিল মধুর ক্যন্টিনে । মধুদা’র পরিবারের ওপর আক্রমণ হয়েছে। তাতে একাধিক সদস্য নিহত হয়। এছাড়া রোকেয়া হলে ধোপা বাসুদেবকে তার পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে। রোকেয়া হলে পাকিস্তানী বাহিনী প্রবেশ করেছে।
তিনি জবানবন্দীতে বলেন, হাট খোলা থেকে সাংবাদিক শহিদুল্øাহ কায়সার জানান যে ইত্তেফাক অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ইত্তেফাকের সামনে অনেক লোককে পাকিস্তানী হানাদাররা গুলি করে হত্যা করেছে। এবং তার ভেতর লেখক, সাংবাদিক শহীদ সাবের জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এই রকমই বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগানো হয়েছে। মানুষের লাশ যত্রতত্র পড়ে আছে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আমাদের আত্মীয় সাত্তার জুট মিলে ছিলেন। তাঁরা জানালেন, সেখানেও হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। একটি বাড়িতে ঘরের ভিতর ঢুকে মশারীর ভিতর থেকে মা ও শিশুকে একই সঙ্গে হত্যা করা হয়। আস্তে আস্তে আরও জানতে পারি, যে চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোহর ও রাজশাহী সর্বত্র হত্যাকান্ড চলছে। এবং পুলিশের বড় কর্মকর্তা মাসুম মাহমুদকেও হত্যা করা হয়েছে। যিনি খুলনা এলাকাতে পুলিশের বড় কর্মকর্তা ছিলেন।
বিভিন্ন জেলায় বাঙালী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের হত্যা করা হযেছে। একটু পেছন দিকে যেতে চাই, ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে যে লেক আছে সেই লেকের পাড়ে এবং তার কাছে ধানম-ি গার্লস হাইস্কুল ছিল। তবে সেখানে কোন বাড়ি ছিল না। সেই স্কুলের ছাদে মেশিনগান ফিট করা ছিল। ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বলেন, পরে ২৭ মার্চে সকালে আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গেলে দেখতে পাই যে কয়েক জন সেনা সদস্য ৩২ নম্বরের ওই বাড়ি থেকে মালামাল নিচ্ছেন ট্রাকে তুলে। তার পরে কারফিউ জারি করলে আমরা ঘরে ফিরে আসি। বিবিসি ও অন্যান্য রেডিওতে শুনতে পাই বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অপারেশন সার্চ লাইট নামে একটি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে, যা গণহত্যার শামিল। লাখ লাখ লোক নিজের বাড়িঘড় ছেড়ে এখান থেকে সেখানে, এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে পলিয়ে বেড়াচ্ছে। সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে ৮০ বছরের বৃদ্ধা থেকে শুরু করে শিশু, তরুণ, জোয়ান ও বৃদ্ধ চরম অনিরাপত্তাবোধ নিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে গ্রাম থেকে গ্রামে শুধু প্রাণটুকু রক্ষা করার জন্য যেতেন।
আমাদের মধ্যে এটা মানবতা অবমাননা এবং মানবাধিকারের নিকৃষ্টতম লঙ্ঘন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কিছু ভাল খবর পাই। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এসব খবর পাচ্ছিলাম। আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধব যারা বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তারা মুক্তি যোদ্ধাবাহিনী গঠনের খবর দিচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এবং সেই যোগাযোগের ভিত্তিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমরা দুই বোন মুক্তিযোদ্ধা। আমার মাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন যোগাযোগ করি। আমরা দু’ বোন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। নানাভাবে তথ্য আদান-প্রাদন, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করা এ সব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যা চলছিল। হঠাৎ করে এপ্রিল মাস থেকে আমরা জানতে পারলাম যে দেশের কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পাক হানাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। তখন পত্রপত্রিকায় ওই খবরগুলো খুব ফলাও করে ছাপানো হতো। কাজেই সেই সময় ঘটনাগুলোর সঙ্গে কারা কারা যুক্ত ছিল তাদের নামও জানতে পারি।
এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ঘুরে ফিরেই জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি ও মুসলিম লীগ এই দলগুলোর নামই উঠে আসত এবং একটি নাম আমাদের খুব বেশি বেশি ভেসে উঠত যিনি গোলাম আযম। যিনি টিক্কাখান ও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হতেন। গোলাম আযম তার বক্তৃতা বিবৃতিতে সর্বদা পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার দুটি বিষয় উঠে আসত। যার একটি হলো : পাকিস্তান অর্থই হলো ইসলাম। পাকিস্তানের বিরোধিতা মানে ইসলামের বিরোধিতা করা। তিনি বলেন, গোলাম আযম বলতেন ইসলামকে রক্ষা করতে হলে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে এবং যারা তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা তারা দুষ্কৃতিকারী তাদের নির্মূল করতে হবে।
এবং যারা তাদের ভাষায় মুক্তিযোদ্ধা তারা দুষ্কৃতকারী । তাদের নির্মূল করতেই হবে। এ এজন্য দেশ বাসীকে উজ্জীবিত (উদ্বুদ্ধ) করতে হবে। সেই দায়িত্ব তারা নিতে চান। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই তারা প্রথম শান্তি কমিটি নামে কিছু সাংগঠনিক তৎপরতা চালায়। জনগণকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর পর মে মাসে রাজাকার বাহিনী নামে একটি বাহিনী তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, আমার যদ্দুর মনে পড়ে প্রথম রাজাকারের সূচনা হয়েছিল খুলনায়। এও জানতে পারি যে তারা (কিলার ফোর্স) আল-বদর, আল-শামস্ ( গোপন হত্যাকারী) বাহিনী হিসেবে গঠন করা হয়। তারা জামায়াতের নেতৃত্বে গোপনে কাজ করবে এই উদ্যেশ্যেই তৈরি করা হয়। আমরা জানতে পারি, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের তরুণ কর্মীদের নিয়ে আল-বদর বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
সাক্ষী সুলতান কামাল বলেন, তখনকার ওই সময় এসব কর্মকা-ের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে গোলাম আযমের নাম-ই বার বার উচ্চারিত হয়েছে। তিনি বলেন, গোলাম আযমের নাম ধরে পাকিস্তানের সেনা বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে ও টিক্কাখানসহ অনেকে তার প্রশংসা করেছেন। তারা বলত তিনি আমাদের জন্য এত কাজ করেছেন। তিনি পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা করতে সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। সে সময় তিনি পাকিস্তান সফর করেছেন। ঐ সফরে দিয়ে তিনি বার বার এই কথা বলেন, তিনি পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা করার জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত।
জুন মাসের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার ছোট বোন সাঈদ কামাল এবং আমি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের বাড়ির সামনে উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান থাকতেন। তিনি খবর পাচ্ছিলেন যে, বিমানবাহিনীতে যে বাঙালী কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের যখন ডাকা হয় তারপর আর ফিরে আসেন নি। এ রকম একটা সময়ে তাঁকে হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করতে বলা হয়। এবং নির্দেশ দেয়া হযেছিল, রায়ের বাজারের কাছে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় একটি অপারেশনে যেতে হবে। তখন তিনি আমার মায়ের কাছে এসে সাহায্য চান। কি ভাবে এই পরিস্থিতি থেকে তিনি বাঁচতে পারেন। আমরা তখন তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে সাহায়্য করি।
দুঃখজনক তাঁর বাড়ির কাজের ছেলেটি ছিল, তাকে পাক বাহিনী পরের দিন ধরে নিয়ে যায়। হামিদুল্লাহ খান সাহেবের পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে সাহায্য করেছিলাম। তখন একটা শঙ্কা দেখা দিল, কাজের ছেলেটি যদি জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের পরিবারের সঙ্গে যে যোগাযোগ হচ্ছিল হািমদুল্লাহ খান সাহেবের সেটা বলে দেয় তা হলে হয়ত আমাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে তা প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। সেই কারণে আমাদের পরামর্শ দেয়া হলো আমরা দু’বোন অন্তত সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যাই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, তার পর সে সময় তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ১৬ জুন ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে ভারতের সোনামুড়া পৌঁছি। সেখানে আমাদের পরিচিত ডাক্তার যিনি সেনা অফিসার ছিলেন তিনি সোনামুড়া ফরেস্ট বাংলোতে চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা করা হতো। এটা ছিল ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে। তখন আমরা দু’বোন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই।
আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নির্বাচিত হলাম। সেখানে থাকতেই একটি বড় হাসপাতালের পরিকল্পনা নেয়া হলো। আগরতলা থেকে ৭ মাইল দূরে ইসলাম গঞ্জ নামক জায়গায় এই হাসপাতালটি প্রতিষ্টিত করি। আমাদের সঙ্গে জড়িত হন, ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, ডা. মোমেন, ডা. কামারুজ্জামান প্রমুখ। যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অত্যন্ত সম্মানিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। ডা. ক্যাপ্টেন সেতারা এসে যোগদান করেন আগস্ট মাসে। যিনি পরবর্তীতে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। আমাদের প্রথম দিকে যিনি সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি ক্যাপ্টেন আকতার আহম্মেদ। পরবর্তীতে তিনিও বীরপ্রতীক উপাধিতে ভুিিষত হন।
সাক্ষী তার জবানবন্দীতে বলেন, আমারা সেখানে যাবার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে যারা ভেতরেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন, তারা এসে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে হাসপাতালে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, প্রফেসর জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, নিুরুপমা, পদœা, নিলীমা, ডা. ডালিয়া সামসুদ্দিনসহ একত্রে আমরা কাজ করি।
আমরা দেশের অভ্যন্তরে খরবারখবর নিতাম। বিভিন্ন বেতার বিশেষ করে বিবিসি, আকাশ বাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং আমেরিকা থেকে আমার ভাই মাকে চিঠি দিত, সেই চিঠি আবার আমাদের জানানো হতো। তদুপরি মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য দেশের ভিতর প্রবেশ করত তারা ফিরে আসলে তাদের কাছ থেকেও খবর পেতাম।
সাক্ষী আরও বলেন, ২ নম্বর সেক্টরে যে সব মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করত তাদের মাধ্যমে সেই সব অপারেশনের খবর বেঙ যারা দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করত অর্থাৎ শান্তিকমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল সামস তাদের খবরও পেতাম। শেরাটন হোটেলে বোমা হামলার ঘটনা রুমি, বদি, আলম, বাদল, চুন্নু, সামাদ, আলী গং গেরিলা অপারেশনের নিয়মিত খবর হাসপাতালে বসেই পেতাম।
সোমবার এই পর্যন্ত জবানবন্দী প্রদান করা হয়েছে। আর অবশিষ্ট অংশ জবানবন্দী প্রদান করবেন আজ। এর আগে একই ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আরও দু’জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি পেশ করেছেন। তাঁরা হলেন বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম(এসপি মাহাবুব)। তারা ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী পেশ করার পরে তাদের জেরা করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। এর আগে গত ১ মে সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। পরে ৫ জুন তার বিরুদ্ধে (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের কাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
১ জুন পাঁচ ধরনের ঘটনায় ৬২টি অভিযোগের মধ্যে মোট ৬১টি ঘটনার ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করা হয় জমায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। তার আগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯১পৃষ্ঠার অভিযোগ উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন পক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ধরনের সিডি ভিসিডি এবং প্রামান্য দলিল হিসেবে পত্রিকার কাটিং এবং এসবের সঙ্গে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র পক্ষের অভিযোগ উপস্থাপন শেষ হয়। ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার পর গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় ট্রাইব্যুনাল। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।

সাঈদী
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামাযাতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী প্রদান করেছেন তৃতীয় সাক্ষী মোঃ নুরুল হক হাওলাদার (৬০)। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এই জবানবন্দী প্রদান করা হয।
সাফাই সাক্ষী মোঃ নুরুল হক হাওলাদার জবানবন্দীতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে পিরোজপুরের পাড়েরহাটে ফকির দাসের ভবনে শান্তি কমিটির কার্যালয় বা রাজলক্ষ্মী হাইস্কুলে রাজাকার ক্যাম্পে কোথাও সাঈদীকে তিনি দেখেননি। এ ছাড়াও পাড়েরহাটে যে দোকানপাট লুটপাট হয় সেখানেও সাঈদীকে দেখা যায়নি। মোঃ নুরুল হকের জবানবন্দী শেষ হলে তাঁকে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী জেরা শুরু করেন। জেরা অসমাপ্ত রেখে এ মামলার কার্যক্রম কাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.