দিস ইজ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম by মাহমুদ মেনন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে যা ঘটে গেল তার প্রথম অংশটুকু উদ্বেগের, পরের টুকু লজ্জার এবং শেষটুকু গৌরবের। উদ্বেগ ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যারা ভালো ফলের প্রত্যাশা করছিলেন তারা যখন দাবি করলেন ফল সঠিক নয়। উদ্বেগের মাত্রা ক্রমেই ঘণীভ’ত হলো যখন এই অভিযোগকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার উত্তরপত্রে ভুল এমন দাবি করা হয়তো সহজ কিন্তু তা প্রমাণ করা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি করেছেন বাংলানিউজের বিশ্ববিদ্যালয় করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসান। তার অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে বের করে ভুলগুলো। তার ভিত্তিতেই বাংলানিউজে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ‘ঢাবিতে ভর্তি: গ ইউনিটের উত্তরপত্রে ভুল’ এই শিরোনামে।

অনলাইন সংবাদমাধ্যমের এই এক সুবিধা, খবর নিমিষে ছড়িয়ে পড়ে। এমন একটি খবর নিঃসন্দেহে লজ্জার তাই ছড়িয়ে পড়াটা মোটেই উপভোগ্য নয়। কিন্তু কী করার?

ওই প্রতিবেদনে মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উত্তরপত্র’ ভুলে ভরা। ‘এ’ সেটের ইংরেজি বিষয়ের  কমপক্ষে ৪টি প্রশ্নের ভুল নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে অপর একটি  সূত্র জানায়, ‘এ’ সেটের ইংরেজিতেই ভুল রয়েছে কমপক্ষে ৬টি উত্তর। এছাড়া বাংলা ও হিসাববিজ্ঞানেও বেশ কয়েকটি ভুল রয়েছে। কেবল ‘এ’ সেটেই নয়, প্রত্যেকটি সেটের ‘উত্তরপত্রে’ রয়েছে একই রকম ভুল। আর খোদ উত্তরপত্রেই ভুল থাকার কারণে কোনও শিক্ষার্থী সঠিক উত্তর দিলেও মূল্যায়নে তার উত্তর ভুল হিসেবে দেখা হয়। যা নিয়ে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা।’

বাংলানিউজে রিপোর্ট প্রকাশের পরে এ নিয়ে বসে পরীক্ষা কমিটির জরুরি বৈঠক। বৈঠকে বাংলানিউজে প্রকাশিত উত্তরপত্রের অসঙ্গতিগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়। এরপরই কমিটি ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন শুরু করে।

লজ্জার বিষয়টি আরও জোরদার হয় যখন বাংলানিউজের বিশ্ববিদ্যালয় করেসপন্ডেন্ট তোপের মুখে পড়েন। তাকে চাপ দেওয়া হয় উত্তরপত্রে ভুল তা তিনি কী করে জানলেন, তা জানাতে।

তথ্যসূত্র জানাতে কোনো প্রতিবেদকই বাধ্য নন, তাকে চাপও দেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কমিটির শিক্ষকরা তা না জানলেও জানেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই শিক্ষক, আজীবন ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানো মানুষটি ঠিকই মাহমুদের পাশেও দাঁড়ালেন। তিনিই বললেন, ‘সূত্র থেকে পাওয়া খবর এবং তাতে দেওয়া তথ্য সঠিক। সুতরাং তার কোনো অপরাধ নেই। দিস ইজ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম।’

পুরো বিষয়টিতেই মাহমুদ উত্তেজিত। তার মুখে যেনো কথা সরে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অসংখ্য শিক্ষার্থীর প্রিয় এই শিক্ষকের কথায় মাহমুদ গর্বিত। গর্বিত তার হাজারো শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকতা পেশার সকলে।

ভুলগুলো মাহমুদ কোনো সূত্রের মাধ্যমে জানেননি। ওগুলো খুঁজে পায় তার অনুসন্ধানী চোখ। তাই এখানে তা উল্লেখ করা হলো। আশা করি পরীক্ষা কমিটি তাতে তুষ্ট হবে।

বেশ কিছু পরীক্ষার্থী যখন অভিযোগ তুলছিলো তখন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মাহমুদুল হাসান যান বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন ও গ-ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদের কক্ষে। সেখানে প্রশ্ন করা হলে, ডিন জোর দিয়ে  বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরপত্রে কোনো ভুল নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে এ উত্তরপত্র করানো হয়েছে এতে ভুল থাকার প্রশ্নই আসে না।’

ডিন যখন কথা বলছিলেন তখন তার টেবিলের ওপরই রাখা ছিলো উওরপত্রের একটি কপি। সেটি ছিলো ইউনিটের ইংরেজি অংশের উত্তরপত্র। লুকিয়ে অত্যন্ত ক্ষীপ্রতার সঙ্গে ২৫টি প্রশ্নের উত্তর মাহমুদ তুলে নেন তার নোটবুকে। ডিন অফিস থেকে বের হয়ে মাহমুদ ‘গ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র সংগ্রহে নেমে যান। ফার্মগেট এলাকায় একজনের কাছ থেকে সেটি সংগ্রহ করেন। এরপর শুরু হয় উত্তর মিলিয়ে দেখার কাজ। একজন বিশেষজ্ঞকে সাথে নিয়ে, একাধিক ডিকশনারি ও নামকরা ইংরেজি ব্যকরণের বই খুলে মিলিয়ে দেখেন উত্তরগুলো। ২৫টি উত্তরের মধ্যে অন্তত ৪টি ভুল শনাক্ত হয়। তার ভিত্তিতেই মাহমুদ বাংলানিউজে রিপোর্টটি করেন।

রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে ক্যাম্পাসে হৈ চৈ পড়ে যায়। তার ডাক পড়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে। সেখানে মাহমুদ উপাচার্যকে তার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যগুলো দেখান। তাতে ভুলের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে তিনিই পরীক্ষা কমিটিকে বিষয়টি জানান।

পরে ভিসির নির্দেশেই কমিটি পরীক্ষার উত্তরপত্রগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে বসে। তাতে ইংরেজির চারটি ভুলসহ মোট ১২টি অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এরপর ওই অসঙ্গতিগুলো সঠিক করে সারারাত ধরে আবার মূল্যায়ন করা হয় পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তর পত্র। এতে ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেরই মেধাক্রম উল্টে যায়। বাদ পড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীর নাম চলে আসে মেধা তালিকায়। বাদও পড়ে সমানসংখ্যক নাম।

যোগ্যদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এই সুযোগ সৃষ্টি হয় একটি রিপোর্টের মধ্য দিয়ে। যাকেই উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম বলে উল্লেখ করেছেন।

মাহমুদুল হাসানের এই কৃতিত্বে বাংলানিউজের পক্ষ থেকেও তাকে জানানো হয় অভিনন্দন। এরই মধ্যে এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন তাকে ৫,০০০/- (পাঁচ হাজার টাকা) পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.