আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

আমাদের বাল্যকালে দরজি বাসায় এসে জামা-প্যান্টের মাপ নিতেন। আব্বার সাথে দোকানে গিয়ে পছন্দমত কাপড় কিনে দরজির দোকানে পেঁৗছে দিতাম। বাড়িতে শাড়ির বোঝা নিয়ে ফেরিওয়ালারা একের পর এক আসতেন।

মা দরজার আড়াল থেকে আমার মাধ্যমে ঈদের শাড়ি পছন্দ করতেন আর দরদাম করতেন। আমরা দু'ভাই মাঝে মাঝে দরজির দোকানে যেয়ে খোঁজ নিতাম শার্ট-প্যান্ট তৈরি শেষ হলো কিনা। সেমাই তৈরি করার মতো ঈদের কাপড় চোপড় তৈরির ব্যাপারটিও রোজার দিনগুলো ব্যাপী চলত।
এখনকার মতো কোনোটিই একদিন কি দুইদিনে শেষ হতো না। অর্থাৎ রোজার পুরো মাসটি ঈদ আসছে কী আনন্দ এই মধুর মেজাজটি আমরা অনুভব করতাম আমার ছেলেবেলা শেষ হয়েছে ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন শেষ হওয়ার সাথে। অর্থাৎ আমার ছেলে বেলা সে সময়ের যখন বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজ শহরে খুঁটা গেড়েছে। তবে সে সমাজের সদস্যরা তৎকালের জীবনযাত্রার মানে স্বচ্ছল হলেও তাদের বাড়তি অর্থ ছিল না। এতে তারা কিন্তু অসন্তুষ্ট ছিলেন না বরং সরল জীবন যাপনে ও সৎ থাকতে অভ্যস্ত ছিলেন। তখন ভবিষ্যতের পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশটির সাধারণ জনগণ তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ছিলেন যাদেরকে আমরা কাবুলিওয়ালা বলতাম। রোজার মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে একজন কাবুলিওয়ালা আমরা যে মফস্বল শহরে থাকতাম সেখানে হাজির হতেন। এ রকম এক একজন কাবুলিওয়ালা সম্ভবত তাদের মধ্যে রফা অনুযায়ী এক এক শহরে হাজির হতেন। এরা রোজার মাসের প্রতি সেহরির সময়ের আগে শহরের মহলস্নায় সবাইকে জাগিয়ে দিতেন। এরা উদর্ুভাষায় গানের সুরে চেঁচিয়ে দৌড়ে শহরটির চারদিকে ঘুরতেন। তাদের গানের যে কথাগুলো মনে আছে সেগুলো এই জাগো, জাগো, দুধ বাতাসা পিয়া করো। এখনও অনুভব করি এই কাবুলিওয়ালারা শহরে রোজার আমেজ ছড়িয়ে দিতেন। শুধু তাইই নয়, ঈদের আগমনী সৌরভও বয়ে আনতেন। বিদায় নেয়ার সময় তারা শহরের পরিবারদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক পেতেন।
আমাদের বাল্যকালে ঈদের দিনটি সহসা হাজির হতো না। রমজান মাসটি জুড়ে প্রত্যেক পরিবারে কী কী সেমাই রান্না হবে তার প্রস্তুতি নেয়া হতো। এখনকার মতো বাাজরে সেমাই বিক্রি হতো না। কিংবা হলেও তার চাহিদা ছিল না। প্রত্যেক বাড়িতে একটা করে সেমাই কল খরিদ করা থাকত। একটা চৌকির অগ্রপ্রান্তে স্ক্রু দিয়ে এটে সেমাইকলের মুখে ময়দা ঠেসে দেয়া হতো এবং মাথার ওপর সাঁটা হ্যান্ডেলটি চক্রাকারে ঘুরালে চাকতির ফুটো দিয়ে সুতোর মতো সেমাইগুলো ধীরে ধীরে নেমে এলে তলায় রাখা পাত্রে চক্রাকারে জমা করা হতো। তারপর সেগুলো রোদে শুকানো হতো। সেমাইকলের চাকতি কয়েকটি থাকত। কোনটির ছিত্র সরু আবার কোনটির ছিদ্র ছিল মোটা। সরু সেমাই দিয়ে ঘি চিনি সহযোগে মা শুকনা সেমাই রান্না করতেন আর মোটা সেমাই দিয়ে দুধ, গুড় সহযোগে রান্না করতেন। একটি পদ রান্নায় চিকন সেমাই আর অপর পদটি রান্নায় মোটা সেমই বেছে নেয়ার মধ্যে আমার রাধুনী মায়ের যে বাহাদুরি ছিল সেটা দুই পদ রান্নার মনোহরিত্ব পৃথকস্বাদে টের পাওয়া যেত। হঁ্যা, সেমাই কল ঘুরিয়ে চালানোর সময় আমাদের দু'ভায়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। আবার দুই ভাই মিলে ছাদে সেমাই শুকানোর সময় লাঠি হাতে কাক-শালিক-চড়-ই পাখিদের তাড়াতে বেশ মজা পেতাম।
কলে তৈরি সেমাই ছাড়াও আরো দুই পদের সেমাই মা তৈরি করতেন। একটার নাম ছিল চুটকি সেমাই। ময়দার আটার চিকন লেচি করে বুড়ো ও তর্জনি আঙ্গুল দিয়ে চালের আকারে সেমাই তৈরি করা হতো। আবার এগুলো মোটা করে পাত্রে ফেলে বুড়ো আঙ্গুলে চাপে চিড়ার আকারে সেমাই তৈরি হতো। চুটকি সেমাই শুকনো রান্না হতো আর চিড়া সেমাই দুধে রান্না হতো। আকারের ও রান্নার পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে দুটো পদের স্বাদ অপূর্ব লাগতো। এই প্রসঙ্গে যখন লিখছি তখন মায়ের ফর্সা রঙের আগুলগুলোর নাড়াচড়া যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রোজার মাসের প্রথম দিন থেকে ঈদের দিনতক এখনও আমার মায়ের স্মৃতি মনের মুকুরে ধরা দিতে থাকে।
আমাদের বাল্যকালে দরজি বাসায় এসে জামা-প্যান্টের মাপ নিতেন। আব্বার সাথে দোকানে গিয়ে পছন্দমত কাপড় কিনে দরজির দোকানে পেঁৗছে দিতাম। বাড়িতে শাড়ির বোঝা নিয়ে ফেরিওয়ালারা একের পর এক আসতেন। মা দরজার আড়াল থেকে আমার মাধ্যমে ঈদের শাড়ি পছন্দ করতেন আর দরদাম করতেন। আমরা দু'ভাই মাঝে মাঝে দরজির দোকানে যেয়ে খোঁজ নিতাম শার্ট-প্যান্ট তৈরি শেষ হলো কিনা। সেমাই তৈরি করার মতো ঈদের কাপড় চোপড় তৈরির ব্যাপারটিও রোজার দিনগুলো ব্যাপী চলত। এখনকার মতো কোনোটিই একদিন কি দুইদিনে শেষ হতো না। অর্থাৎ রোজার পুরো মাসটি ঈদ আসছে কী আনন্দ এই মধুর মেজাজটি আমরা অনুভব করতাম।
এখন বুড়ো কালে ঈদ আসে ওই দিনই, বড় জোর তার আগের দিনে। ঈদের জন্য কাঁচা বাজার একদিন কি দুইদিনে দ্রুত শেষ হয়ে যায়। ঈদের জন্য কাপড় কিনতে দোকানে যাওয়া এখন বিরক্তিকর বিড়ম্বনা। অতি দ্রুত কেনাকাটার কাজটি শেষ করতে হয়। ঈদের আগমনী আনন্দ আমার পৌত্র-পৌত্রী পায় না। ঈদে কি সেমাই রান্না হবে কিংবা কবে ঈদের জামা-কাপড় তৈরি হবে তেমন ব্যাপার স্যাপার আর না থাকায় আমাদের বাল্যকালের মধুর স্মৃতির গল্প করলে আমার পৌত্র-পোত্রী হাসে। তাদের কাছে ওই কাজগুলো হাস্যকর মনে হয়। তারা অতি দ্রুত পিজ্জা কিংবা বার্গার কিংবা দোকানে গিয়ে এক দামের শার্ট-প্যান্ট কিনে আনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
হাল্কা মেজাজে, প্রিয় পাঠক-পাঠিকা ঈদের দিন নিয়ে গল্প-স্বল্প করব বলে লিখতে বসেছিলাম। কিন্তু এই পর্যন্ত লিখে আপন মনে চমকে উঠলাম। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হলো। এখন হচ্ছেটা কি? আমরা কোন্ ফাঁদ আটকে গেছি! এই বিষয়ে অনেক আগেই কার্ল মার্কস সবাইকে সতর্ক করে লিখেছিলেন, বিশ্ববাজারের শোষণের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণী সবদেশে উৎপাদন ও ভোগ ব্যবস্থাকে এক আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে। সব কয়টি পুরাতন ধাঁচের দেশীয় শ্রমশিল্প ধ্বংস করা হচ্ছে। তাদেরকে হটিয়ে দিয়ে নতুন শিল্প গড়া হচ্ছে। সেখানে এখন আর দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার করা হচ্ছে না। ব্যবহূত হচ্ছে দূরবতর্ী অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামাল। এসব শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যগুলো সে দেশেই কেবলমাত্র ব্যবহারে শেষ হচ্ছে না, পৃথিবীর প্রতিটি এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পুরাতন চাহিদাসমস্ত যেগুলো নিজ নিজ দেশের উৎপাদনেই মিটে যেত তার বদলে আমরা দেখতে পাচ্ছি নতুন সব চাহিদা। সেগুলো যদিও সুদূর কিন্তু অন্য কোনো দেশের জীবনাচরণের সন্তুষ্টিযোগ্য। পুরাতন, স্থানীয় ও জাতীয় সয়ম্ভরতার বদলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। সবদিকে আদান-প্রদান, প্রবৃদ্ধি উন্নত দেশনির্ভর।
বিশ্বপুঁজির দৈত্য আমাদেরকে একটি তত্ত্ব গিলতে প্ররোচনা দিচ্ছে। সেটা হচ্ছে শিল্পের প্রসার ঘটলে মানুষের শ্রীবৃদ্ধি হবে। এটা আংশিক সত্য। সকলের নয়, কিছু মানুষের শ্রীবৃদ্ধি হবে এবং তার বদলে অনেকের সর্বনাশ হবে। শিল্প-কারখানার জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ করায় যত মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, শিল্পায়নে তত মানুষের লাভ হবে না যেহেতু আধুনিক শিল্প-কারখানায় কমর্ী হওয়ার জন্য যে ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতার প্রয়োজন, তা তাদের নেই। তাছাড়া একজন কৃষিজীবী সত্তর-পচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত চাষাবাদে সমর্থ থাকেন, কিন্তু একজন শিল্পশ্রমিক পঞ্চাশ, বড়জোর পঞ্চান্ন বছর বয়সতক শিল্পমালিকদের চাহিদামত কর্মদক্ষ থাকেন। তাই পুঁজিবাদী শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভেতরে চতুর্থ বিশ্বের জন্ম হচ্ছে যাদের সদস্য গৃহহীন, জীবিকাহীন, ক্ষুধার্ত, রোগগ্রস্ত মানুষের দল যারা শহরের বস্তিগুলোতে ভিড় করছেন।
আরও এক বিপদ, যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। সেটা হচ্ছে টিভি চ্যানেলের পণ্য সংস্কৃতি যা ধ্বংস করছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আমাদের দেশ প্রধানত পলস্নীবাসী। এই পলস্নী মাঝে মাঝে যখন আপনার নাড়ীর মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্ত চলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠে তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান করে। এই উৎসবে পলস্নী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়। তাহার হূদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান অপলক্ষ্য। যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি পলস্নীর হূদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর হইতেছে মেলা।
====================
আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি  ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ  কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা  আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.