ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস

ভ্রমণ যখন বিমানে হয়, একটা বিস্ময় কিছুতেই আমাকে ছাড়তে চায় না। এই বিম্ময় শেষবার আমাকে পেয়ে বসলো প্রায় দু'বছর আগে, ২০০৯'এর জানুয়ারিতে টরন্টো থেকে হংকং আসার পথে।

বারোচৌদ্দ বগির ট্রেনের যাত্রীর সমান মানুষে ঠাসা ভরাপুরা এই বাহনটি সাড়ে ছ'শ প্যাসেঞ্জার ও তাদের লাগেজ, কেবিন লাগেজ ও তাদের জন্য চৌদ্দ ঘন্টার খাদ্যাখাদ্যসহ আরও ছ-সাতশ' মানুষের ওজন নিয়ে ঘন্টায় হাজার কিলোমিটার বেগে উড়ে যাচ্ছে কীভাবে!
বহু চেষ্টা করেছিলাম জানলার পাশের ও মধ্যের সীট বাদ দিয়ে একটা পাশের সীট, ওরা বলে 'আইল সীট' পাওয়ার জন্য। চেক-ইন কাউন্টারের মেয়েটি অনেকক্ষণ-ধরে চেষ্টাও করলো। জোটাতে পারলো না। পেছন থেকে তৌহিদ, বাল্যের বন্ধু ও স্কুলজীবনের দ্বৈরথে ছ'সাত বছরের টানা বিজয়ী, যার বাড়িতে, টরন্টোয়, পঞ্চাশ দিন মায়ের কোলে থাকার মত করে থাকা, যে এয়ারপোর্টে এসেছিল, মধ্যরাতে হাড়কাঁপানো শীতের ভেতর সী-অফ করতে, বললো- দ্যাখ পাগল, ঐ সীটের জন্য তুই আসল সীটই না শেষ পর্যন্ত হারিয়ে বসিস।
বিমান ভ্রমণের সময়, ট্রেন ভ্রমণের সময়ও, এই চেষ্টাটা সব সময় আমি জারি রাখি টয়লেট ব্যবহারের সুবিধার জন্য।
যেমনটা আগে কখনও করিনি, সেবারই প্রথম করছিলাম। এক কাপ চাও খাইনি, এক কাপ কফিও নিই নি, জু্যস কিংবা পানিও খাচ্ছি স্বভাববিরুদ্ধ কার্পণ্যে। মনের ভেতর কাজ করছিল একটিই ভয়, তেমন করলে ঘনঘন ওয়াশরুমে যেতে হবে। সেটি করতে হলে ডান পাশের তরুণীটিকে বারবার ওঠাতে হবে, ঘনঘন সরি বলতে হবে।
অস্বস্তি শুরু হয়েছিল গোড়া থেকেই। গায়েগায়ে লেগে থাকা সীটের সহযাত্রী মহিলা হতে পারতো, কিন্তু তরুণী হবে কেন! অথবা তরুণীও হোক, তাকে সুন্দরী হতে হবে কেন! সুন্দরীও হোক সে, অমন স্মার্ট হবে কেন! স্মার্টও হোক সে, আমার পাশের সীটটি সে পাবে কেন! তাও না হয় পেলো সে, পরিচ্ছদে সজ্জায় অত সাহস তাকে দেখাতে হবে কেন!
মহাসঙ্কট! ঘনঘন তাকানোও যাচ্ছে না, ওঠানোও যাচ্ছে না! ইকনমি ক্লাসের সীটে হাতপায়ের স্পর্শ বাঁচিয়ে নড়নচড়নেও মুশকিল হচ্ছে।
এমন আনন্দদায়ক বিপদে আগে কখনও পড়িনি আমি। এবারও পড়তে হতো না, যদি পরিবারের তিনজনের কেউ সঙ্গে থাকতো, যদি না এতটা পথ নন স্পট ফ্লাইটে একা একা ভ্রমণ করতে হতো। সোজা কথা নয়, ফ্লাইট ছিল চৌদ্দ ঘন্টার,ওড়ার আগে জানতে পারলাম, পরীক্ষা দিতে হবে পনেরো ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট।
এতটা সময় ও এমন দীর্ঘ শাস্তিরকাল কীভাবে কাটবে ভাবছিলাম। একটা কাজ করা যায়, ঐ মেয়েটি যেমন ইয়ার ফোন কানে বসিয়ে ল্যাপ্টালেপ্টি ছবিতে মেতেছে, আমিও তেমনি একটা কাজে লেগে যেতে পারি।
সীটের হাতল থেকে রিমোট খুলে সামনের স্ক্রীনটা যে সচল করবো, পারছিলাম না। সহজ বিষয় সবাই যা পারে, এতবার বিমান ভ্রমণের পরও আমার হাতে তা আসছিল না। টেকনিক্যাল জিনিস হাতে আসতেই চায় না। তাদের সঙ্গে কী দুশমনি আমার তারাই জানে।
কতক্ষণ 'যুদ্ধ' করে নিরস্ত হলাম। মনে মনে নিজেকে বার দশেক ইডিয়ট ডাকলাম। তারপর হাতপা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলাম।
বিস্ময়ের শুরুটা সেখানেই যোগাযোগও। ডান দিক থেকে প্রশ্ন এলো-
:ম্যা আই হেলফ য়ু্য!
অবাক হলাম। শব্দ এলো না। মুখের রেখায় আর ভুরুর কুঁচকোনোয় বিস্ময় এলো। এই মেয়ে তাহলে আমার বিস্তাধ্বস্তি, আর তার পিঠে পাওয়া বিশাল ব্যর্থতারও সাক্ষী হয়েছে! লজ্জা! ভারী লজ্জা!
আমার বিস্ময়ের জবাব সেও দিল প্রাত্যহিক ভঙ্গিতে। তারপর সে, সর্ববিচারে চমৎকার তার হাত ব্যবহার করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব ঠিক করে দিল। তার স্ক্রীনে ফেরত যাওয়ার আগে বললো-
:মুভি?
:থ্যাঙ্কস, আই উইল সিলেক্ট।
: ওয়েল, দিস ইজ হাউ টু ডু ইট।
আমাকে তা বুঝিয়ে দিয়ে সে আবার তার ছবিতে মন দিল। ল্যাপ্টালেপ্টি ছবি।
বেশ কতক্ষণ পর তার ছবি শেষ হলো। তার অনেক আগেই আমি আমার টিভি পর্দাটা অন্ধকার করে রেখেছিলাম। ভালো লাগছিল না। মাঝে মাঝে অকারণেই মুড অফ থাকে। এবারও সে রকম।
ভদ্রমহিলা, মেয়ে মেয়ে বলতে খারাপ লাগছে, এবার তাকে 'লেইডী'তে গ্র্যাজুয়েশন দিয়ে বলি, উঠে পেছনের দিকে গেলেন। সম্ভবত: ওয়াশরুমের দিকে।
প্রয়োজন আমারও ছিল। আমি সামনের দিকে গেলাম। সেরে আসি। সময়টাও কাজে লাগলো, ওকেও ডিস্টার্ব না করে পারলাম।
এসে দেখি, আমার আগেই সে সীটে ফিরেছে। কোন কাজেই তার খুব বেশি সময় লাগে না।
পুরো জার্নিতে আমাদের মধ্যে আর দু'বার কথা হয়েছিল। জার্নির মাঝামাঝি যখন দ্বিতীয়বার খাবার দিচ্ছিল, আমি-নিতে চাচ্ছিলাম না।
কেন নিতে চাচ্ছিলাম না, সে কী করে বুঝলো সেই জানে।
: স্টোমাক-প্রবলেম?
কথাটা যখন সত্য, মাথা আমাকে নাড়তেই হলো।
: ডোন্ট ওয়ারি। এভরি থিঙ্ক উইল বী অলরাইট।
আমার হাতে একটি ট্যাবলেট দিয়ে বললো, খাও, দশ মিনিট পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। চুষে চুষে খাও।
তাই করলাম। মনে হলো, দশ মিনিটও লাগেনি সব ঠিক হয়ে যেতে। চোষা ট্যাবলেট'এর ঘনঘন গলা তরল অন্ননালী বেয়ে মন্থরতায় নিচে নামছিল, আর সব যে ধুয়ে মুছে ঝেটিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছিল। সবকিছু ক্লীন! প্রয়োজন সামলাবার জন্য একেবারে সাফসুতরো!
ক্যাফে পিসিফিক'এর ফ্লাইট-হংকং'এর মাটি ছোঁবার আগে, ঘন্টা খানেক আগে সে জানতে চাইলো-
:কেউ আসবে তোমাকে নিতে?
হংকং তোমার চেনা
:তেমন চেনা নয়, একবার মাত্র এসে তিনদিন ছিলাম। তবে ওসবের কোন প্রয়োজন নেই। আমি ঢাকা-বাউন্ড ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার।
:এয়ারপোর্টে কতক্ষণ থাকতে হবে?
: 'মাত্র' চৌদ্দ ঘন্টা।
: মাই গুড গড! অন্য ফ্লাইট চু'জ করতে!
:ভাড়া বেশি। হাউ অ্যাবাউট য়ু্য?
:আমি ট্রানজিট-প্যাসেঞ্জার নই। আমাকে নিতে আসবে। আমার মেয়ে, আর এক্স-হাজব্যান্ড। মেয়েটি এখনও ওর সঙ্গেই আছে।
খুব অবাক হলাম। তারচেয়ে বেশি নিরাশ হলাম। অকারণে। বিমর্ষতা পাতালে পাঠাবার চেষ্টা করে বললাম-
:মেয়েও আছে তোমার!
:কেন! থাকতে নেই?
: খুব ছোট?
: ছোটও বলি কী করে? থারটিন। অ্যাট দ্য বিগিনিং অভ্ হার টিনজ্। কিন্তু দেখে মনে হবে না। গ্রোথ খুব ভালো।
: ওর মায়ের বয়স কত?
: জানা খুব দরকার?
:তেমন দরকার নেই। বলতে পারো কৌতূহলে।
:আমিও তাহলে বলি, ইটস অ্যা নাম্বার ওনলি। এটি একটি সংখ্যামাত্র!
==============================
গল্প- 'সোনালি চিল' by সৈয়দ মোফাজ্জেল হোসেন  গল্প- 'বোবা ইশারা' by মণীশ রায়  গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা  আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা'  আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ'  আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি  ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ  কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা  আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ রণজিৎ বিশ্বাস


এই ফিচার'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.