মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা -জনগণ আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা করেনি by গোলাম মুরশিদ

২৫ মার্চের রাতেও শেখ মুজিব তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তা থেকে মনে হয়, হামলার আশঙ্কা করলেও, অথবা একাধিক সূত্র থেকে খবর পেলেও, সেই রাতেই সেনা-হামলা হবে—এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। তাই তিনি স্বাধীনতার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি। অথবা কোনো ঘোষণা রেকর্ড করেও রাখেননি। সেদিন সন্ধের পরও বেতার-টেলিভিশনের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল। ইচ্ছে করলে তিনি তা ব্যবহার করতে পারতেন। অনেকে বলেন, তিনি যুদ্ধের ঘোষণা পুলিশের বেতার মারফত দিয়েছিলেন। এ ছাড়া পাকিস্তানি লেখক আহমদ সালিম লিখেছেন, তিনি কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসে ফোন করে একটি বার্তা দিয়েছিলেন, সবাইকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এতে তিনি বলেছিলেন—
‘পাকসেনারা মধ্যরাতে রাজারবাগের পুলিশের দপ্তর আর পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর হামলা চালিয়েছে। প্রতিরোধের শক্তি সংগ্রহ করো এবং স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্যে তৈরি হও।’ (সালিম, ১৯৯৭)
শেখ মুজিব নিজেও দাবি করেছেন, ঝটিকা আক্রমণ আরম্ভ হওয়ার পর তিনি প্রতিরোধ তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন (মুজিব, ‘শোষিতের গণতন্ত্র চাই’, ২৬ মার্চ, ১৯৭৫-এর বক্তব্য)। তাঁর নিজের স্বীকৃতি এবং আহমদ সালিমের কথায় মিল থেকে মনে হয়, সত্যি সত্যি তিনি এই বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বার্তা পাঠানোর পরই টেলিগ্রাফ যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। সে জন্য বার্তাটি কোথাও পাঠানো যায়নি। এ ছাড়া সিদ্দিক সালিকের মতে, রাত ১২টার দিকে একটা অজ্ঞাতপরিচয় বেতারকেন্দ্র থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে তাঁর ঘোষণা শোনা গিয়েছিল (সালিক, ১৯৮৮)। কিন্তু এই ঘোষণা তিনি নিজে শোনেননি, অথবা অন্য কেউ শুনেছেন বলেও উল্লেখ করেননি। তবে মুজিব ৭ মার্চ যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য তা-ই ছিল যথেষ্ট। পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে পারে, তিনি তখনই তারও আশঙ্কা করেছিলেন। তাই সেদিন তিনি বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে। বস্তুত, এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এবং প্রতিরোধ—উভয় ঘোষণাই দেওয়া হয়েছিল—আগে থেকেই দেওয়া হয়েছিল।
তার চেয়ে বড় কথা, মুজিব সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য পুরোপুরি মানসিকভাবে তৈরি করেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া, অন্য কিছুতেই তাঁরা সন্তুষ্ট হতেন না। শেষ দিকে তিনি যে রকম স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন—পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার (কামাল হোসেন, ২০০৬)—তা পেলে জনগণ সে পর্যায়ে আদৌ সন্তুষ্ট হতো বলে মনে হয় না। সে জন্যই ২৬ মার্চ থেকে বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের সর্বত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য তারা অপেক্ষা করেনি। অথবা অন্য কারও ঘোষণার পর প্রতিরোধ আরম্ভ করেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনিই দেখিয়েছিলেন। এবং তিনিই বহু দলে বিভক্ত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার নামে। সেই ঐক্যবদ্ধ জনগণ তাঁদের প্রিয় নেতার ৭ মার্চের ভাষণ অনুযায়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল—এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
অনেকে দাবি করেন, ২৬ মার্চ দুপুরবেলায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে তাঁর একটি ঘোষণা প্রচারিত হয়। ‘বীর উত্তম’ রফিকুল ইসলামের বিবরণ থেকে জানা যায়, সেদিন সকালে বেতারে এই ঘোষণা দেওয়ার জন্য তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুরোধ করেন। তারপর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা মিলে এই ঘোষণাটি লেখেন এবং এটি শুদ্ধ করেন ড. জাফর (রফিক, ১৯৮৬)। চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ লিখেছেন, সেদিন দুপুরের পরে পাঁচ মিনিটের জন্য প্রচারিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের নামে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এম এ হান্নান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক এ ঘোষণা শুনেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। মীর্জা নাসিরউদ্দীন ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী। তিনিও জানান, এম এ হান্নান তাঁকে এই বিশেষ অধিবেশন প্রচারে বাধ্য করেন।
কাজেই সেদিন শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা পাঠ করা হয়েছিল, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অনির্ধারিত এবং সংক্ষিপ্ত অধিবেশনের কারণেই হোক, অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক, এই ঘোষণা বেশি লোকে শুনেছিল বলে জানা যায় না। বেলাল মোহাম্মদও বেতারের কর্মচারীদের কাছে এই ঘোষণার কথা শুনেছিলেন, কিন্তু নিজের কানে ঘোষণাটি শোনেননি। ২৬ মার্চ আগরতলা থেকেও এ ঘোষণাটি শোনা গিয়েছিল বলে ২৭ মার্চের লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। তা ছাড়া আগেই বলেছি, শেখ মুজিব ৭ মার্চই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি আবার ঘোষণা না দিলেও জনগণ যেন সংগ্রাম চালিয়ে যায়। সুতরাং হান্নানকে তিনি ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন কি না, তা বেশি প্রাসঙ্গিক নয়। জিয়াউর রহমানও লিখেছেন, মুজিব ৭ মার্চই গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিলেন—
‘৭ই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে জানালাম না।’ (জিয়াউর রহমান, বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, ১৯৭৪)
শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে হান্নানের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর বেতারকর্মীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। পাহারা দেওয়ার জন্য রফিকুল ইসলাম আগের দিন যে জওয়ানদের বেতার ভবনে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরাও আসেননি। তাই ২৭ মার্চ বেলাল মোহাম্মদ পটিয়ায় যান, সেখানে যে বাঙালি সৈন্যরা ছিলেন, বেতার ভবন পাহারা দেওয়ার জন্য তাঁদের সাহায্য চাইতে। সেখানে গিয়ে শোনেন, সেখানকার সৈন্যদের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন, বেতার ভবন এবং কালুরঘাটে ট্র্যান্সমিটার ভবন পাহারার জন্য কিছু সৈন্য দিতে। তিনটি লরিতে সৈন্য নিয়ে জিয়াউর রহমান তখন নিজেই আসেন কালুরঘাটে।
সম্প্রচার ভবনে বসে বেলাল মোহাম্মদ জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার একটা প্রস্তাব দেন। ঘোষণা দেওয়ার এই সুযোগটি জিয়া সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। বেলাল মোহাম্মদের দেওয়া এক খণ্ড কাগজে তিনি ইংরেজিতে ঘোষণাটি লিখে তারপর বেতারে পড়েছিলেন সন্ধে সাড়ে সাতটার দিকে। এটির অনুবাদ করেন বেলাল মোহাম্মদ নিজে আর এর ভাষা ঠিক করে দেন নাট্যকার মমতাজ উদ্দীন। জিয়া প্রথমে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে লিখলেও, পরে অন্যদের পরামর্শে ‘জাতির সর্বোচ্চ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিচ্ছেন বলে সংশোধন করেন। তিনি নিজে ঘোষণা দেওয়ার পর তাঁর ঘোষণার বাংলা অনুবাদ বারবার পড়ে শোনানো হয় (বেলাল, ২০০৬)। ক্যাপ্টেন অলি আহমদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কোনো ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে বেলাল মোহাম্মদ লেখেননি, যদিও অলি আহমদের লেখা থেকে মনে হয়, এই ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারে তিনিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। (অলি আহমদ, ২০০৪)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জিয়া বিচিত্রা পত্রিকায় তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, ১৯৬৫ সালের শেষ দিকেই, ‘...উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ক্যাডেটদের শেখানো হতো—আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন ওদের [পশ্চিম পাকিস্তানীদের] সবচেয়ে বড়ো শত্রু’ (জিয়াউর রহমান, বিচিত্রা, ১৯৭৪)। যখনকার কথা এখানে জিয়া লিখেছেন, আসলে তখনো শেখ মুজিব জাতির পিতা অথবা বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হননি। বোঝা যায়, এটা ছিল তাঁর অতিভক্তির কথা।
একাত্তরের মার্চ মাসে মেজর জিয়ার নাম দেশে সাধারণ মানুষের জানা ছিল না। বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে সিনিয়রও ছিলেন না। তার চেয়ে বড় কথা, তিনি ঘোষণা দেওয়ার অন্তত ৪০ ঘণ্টা আগে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি নিরাপত্তাকর্মী এবং ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিল। তাঁর ঘোষণা শুনে কেউ সংগ্রাম আরম্ভ করেনি। কিন্তু এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, তাঁর ঘোষণা বাংলাদেশের যেসব জায়গায় শোনা গিয়েছিল, সেসব জায়গার লোকেরা দারুণ উত্সাহিত হয়েছিল। আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, তাজউদ্দীন এবং তিনি ফরিদপুর অথবা কুষ্টিয়ার কাছে একটা জায়গায় বসে এই ঘোষণা শুনতে পান। তাঁরাও উত্সাহিত বোধ করেন (আমীর-উল ইসলাম, ১৯৯১)। যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, এ ঘোষণা শুনে তাঁরাও অনুভব করেন, তাঁরা একা নন, দেশের অন্যত্রও যুদ্ধ হচ্ছে। সেদিক থেকে বিচার করলে, জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণা ছিল ঐতিহাসিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাই বলে, ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে তাঁর নাম ভাঙিয়ে একদল লোক যে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাকে অসাধু চেষ্টা এবং সুবিধাবাদ ছাড়া কিছুই বলা যায় না।
[প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য গোলাম মুরশিদের বই মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর থেকে]
গোলাম মুরশিদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.