শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জনের সম্ভাবনা -শিক্ষা দিবস by নুরুল ইসলাম

বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের প্রতীক ১৭ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক ‘শিক্ষা দিবস’। শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, ত্যাগ, বিজয়, গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক এই শিক্ষা দিবসের এবার ৪৭তম বার্ষিকী। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতিভূ সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করে সবার জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণমুখী, বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, সহজলভ্য, আধুনিক শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ছাত্রসমাজ অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক আইয়ুব খান তত্কালীন শিক্ষাসচিব এস এম শরিফকে চেয়ারম্যান করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন। এই কমিশন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আয়ুব সরকার এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’তে যেসব বিষয় সুপারিশ করা হয় তার মধ্যে ছিল: শিক্ষাকে ব্যয়বহুল পণ্যের মতো শুধু উচ্চবিত্তের সন্তানদের স্বার্থে সীমিত করা; সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত করে ফেলা; শিক্ষাব্যয় পুঁজিবিনিয়োগ হিসেবে দেখে শিক্ষার্থীদের তা বহন করা; যে অভিভাবক বেশি বিনিয়োগ করবেন তিনি বেশি লাভবান হবেন; অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে ‘অবাস্তব কল্পনা’ বলে উল্লেখ; ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে স্নাতক পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক; উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা; সাম্প্রদায়িকতাকে কৌশলে জিইয়ে রাখার চেষ্টা ইত্যাদি।
এসব বিষয় ছাত্রসমাজ ও সচেতন মহলকে দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এরই পরিণতিতে শিক্ষার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন ব্যাপক রূপ লাভ করে এবং ১৭ সেপ্টেম্বরের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন আইয়ুব সরকারকে বাধ্য করে ওই শিক্ষানীতি স্থগিত করতে। তত্কালীন দুই বৃহত্ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এবং ডাকসু, বিভিন্ন হল ও কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সাধারণ ছাত্রসমাজের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। যার ফলে সব আন্দোলন ও কর্মসূচির প্রতি সাধারণ ছাত্রসমাজের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সারা দেশে হরতাল ঘোষণা করে। ওই দিন ঢাকাসহ দেশের সব শহরের রাজপথে বিরাট বিক্ষোভমিছিল চলতে থাকে। লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস প্রভৃতি তা দমন করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে ছাত্রদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল আব্দুল গনি রোড হয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ পেছন থেকে অতর্কিতে তার ওপর গুলিবর্ষণ করে। ওই দিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। বহু ছাত্র-জনতা পুলিশ ও ইপিআরের নির্যাতন ও গুলিতে সারা দেশে আহত হন। ১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ছাত্র আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ জনগণ ছাত্রসমাজের প্রতি আরও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে। আইয়ুবের সামরিক সরকার তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এবং একটি গণমুখী সর্বজনীন আধুনিক শিক্ষানীতির দাবিতে, ঐতিহাসিক ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র আন্দোলন ও শহীদদের আত্মদান তথা শিক্ষার ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক ১৭ সেপ্টেম্বরকে সেদিন ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বহু উত্থান-পতনের মধ্যেও প্রতিবছর এই দিনটি ছাত্রসমাজ এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছে।
তত্কালীন সরকার ১৯৬৪ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিশন গঠন করে নতুন মোড়কে তাদের পরিকল্পিত শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থা কায়েমের পথ গ্রহণ করে। কিন্তু প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশে ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আধুনিক গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেও ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর প্রায় অর্ধডজন শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে আজও একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
২.
এবারের শিক্ষা দিবস এক নতুন সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতে উদ্যাপিত হচ্ছে। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের অভূতপূর্ব রায়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার গঠনের পর ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবসের মূল লক্ষ্য এবং জাতির আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের এক বিরাট সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপকল্প-২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন, তা আমাদের বাস্তবায়ন করতেই হবে। সে জন্য আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। আমাদের নতুন প্রজন্মকে যুগোপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে এবং এই দক্ষ নতুন প্রজন্মকেই তা বাস্তবে প্রয়োগ করে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
২০১১ সালের মধ্যে সব শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা, ঝরে পড়া বন্ধ করা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা একেকটি বড় বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক উন্নয়ন ও প্রসারের মাধ্যমে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা, মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং উচ্চশিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করাসহ সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যে অনেক বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা কার্যকর করতে শুরু করেছি। আশা করি, এগুলো দেশবাসীর অজানা নয়। তবে এগুলোর সুফল পেতে সময় লাগবে। শিক্ষকেরা আমাদের আসল শক্তি। তাঁদের প্রতি দায়িত্বপালনে আমরা সচেতন রয়েছি। আবার তাঁদের কাছেও জাতির দাবি, আমাদের নতুন প্রজন্ম ও জাতির ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে তাঁরাই প্রস্তুত করে দেবেন। একদিকে মানসম্মত আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে হবে; সেই সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করে প্রকৃত শিক্ষিত, জ্ঞানী, সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি, পশ্চাত্পদতার অবসান ঘটিয়ে, আধুনিক-উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য সামনে রেখে, বাষট্টির ঐতিহাসিক শিক্ষানীতির আন্দোলনের ৪৭ বছর পর, এবার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আমরা খসড়া শিক্ষানীতি সবার মতামত গ্রহণের জন্য ওয়েবসাইটে (www.moedu.gov.bd) দিয়েছি। সবার মতামত নিয়েই তা চূড়ান্ত করতে চাই। আমরা আশা করব, দেশের সব শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মানুষ এবং দলমতনির্বিশেষে সাধারণ জনগণ তাদের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ দিয়ে প্রস্তাবিত খসড়া শিক্ষানীতিকে চূড়ান্ত করার কাজে এগিয়ে আসবেন। (সংক্ষেপিত)
নুরুল ইসলাম: শিক্ষামন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

No comments

Powered by Blogger.