চোখের আলোয় দেখেছিলেম by অদিতি ফাল্গুনী

‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে!’ রবীন্দ্রনাথের এই বহুগীত গানটি আবারও মনে পড়বে, যদি আপনি মিরপুরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে যান। ‘জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র’ নামাঙ্কিত এই প্রতিষ্ঠানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাড়াও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্যও বিশাল সবুজ ক্যাম্পাসে আরও দুটো আলাদা স্কুল রয়েছে।
‘মনে আমার ঝলসে ওঠে একাত্তরের কথা, পাখির ডানায় লিখেছিলাম প্রিয় স্বাধীনতা’—১২ বছরের দৃষ্টিশক্তিহীণ বালক মোখলেসুর রহমান খুব আবেগ মিশিয়ে আবৃত্তি করে শোনাল শামসুর রাহমানের কবিতা। ব্রেইলে সাদা কাগজের ওপর ফুটো করে করে সে নিজেও কবিতা ও ছড়া লেখে।
একা মোখলেসুরই নয়, চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী ও ১৩ বছরের কিশোরী শিল্পী ও তার সহপাঠী ফাহিমা, কাকলী, তাহমিনা, ডালিয়া, তমা সবাই মিলে টিফিন বিরতিতে কোরাস গাইছিল।
জীবনে কী হতে চায়, এমন প্রশ্নের উত্তরে কেউ গায়িকা, কেউ শিক্ষক আবার কেউ দুটোই হতে চাইল। চতুর্থ শ্রেণীতে প্রথম হওয়া ফাহিমা বলল, ‘জীবনে বড় কিছু করতে চাই!’
‘আমাদের এই স্কুলে মোট ৫০ জনের মতো আবাসিক ও ২০ জনের মতো অনাবাসিক ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এ ক্যাম্পাসের ভেতরই ছেলেমেয়েদের আলাদা হোস্টেল রয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ওরা এখানে আসে। স্বাভাবিক বয়সের তুলনায় এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শুরু করে একটু দেরিতে। কাজেই হয়তো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীর বয়স দেখা যায় অনেক সময় ১৩ বা ১৪।’ বললেন এই স্কুলে ১৯৯১ সাল থেকে কর্মরত শিক্ষিকা মরিয়ম খাতুন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সেরাজুল হক ভুঁইয়া বললেন, ১৯৯১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নরওয়েজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য ব্লাইন্ড অ্যান্ড পার্শিয়ালি সাইটেড প্রজেক্টের আর্থিক সহায়তায় এই বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র যাত্রা শুরু করে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্কুল সিলেবাসে ব্রেইল ইংরেজি, বাংলা, ব্র্র্র্র্র্রেইল বাগানবিদ্যা, মুরগি চাষ, গণিত শিক্ষা, বিজ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষা, চলাচল গতি এডিএল (অ্যাক্টিভিটিজ ফর ডেইলি লিভিং) শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞানসহ প্রভৃতি পাঠ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সেরাজুল হক আরও বলেন, ‘বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতে একটি করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল ছাড়াও পাঁচটি বিভাগীয় শহর অর্থাৎ ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রাজশাহীতে আরও পাঁচটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল রয়েছে। তবে এ স্কুলগুলোতে সাধারণত পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আমরা শিক্ষা দান করে থাকি। যারা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত টিকে থাকে, তারা পরে অন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বিশেষ ব্যবস্থায় পড়াশোনা চালিয়ে যায়।’
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক কক্ষে বসেই পরিচয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র শরিফ আহমেদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু নাঈম মামুনের সঙ্গে। ‘এই স্কুলেই আমরা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি।’ বললেন এ দুই বন্ধু। আইনের ছাত্র শরিফ পড়াশোনা শেষে ঢাকা হাইকোর্টে প্রাকটিস করতে চান। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব হবে কি না তিনি জানেন না।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলের একাধিক শিক্ষক যেমন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম কিংবা কল্পনা আক্তার তাঁদের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান ও স্নাতকোত্তর অর্জন করে শিক্ষক পেশা গ্রহণ করেছেন।
সাধারণত গ্লুকোমা থেকে চোখে পানি জমে যাওয়া, ক্যাটারাক্ট বা ছানি পড়া, গুটি বসন্ত, শৈশবে টাইফয়েড বা জ্বর, উত্তর বাংলা অঞ্চলে দারিদ্র্য ও অপুষ্টি, দুর্ঘটনা প্রভৃতি অন্ধত্বের প্রধান কারণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বললেন, ‘আমাদের এখানকার প্রতিবন্ধী শিশুদের শতকরা ৬০ ভাগই নিকটাত্মীয়দের ভেতর যেমন চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো, খালাতো ভাইবোনের ভেতর বিয়ের ফলাফল। সময় এসেছে নিকট রক্তে বিয়ের এই প্রচলনটি পরিবর্তনের।’
আট বছরের শিশু রূপমের কথা কিছুতেই ভোলা যাবে না। অসম্ভব মিষ্টি দেখতে এই শিশুটির মাত্র আড়াই বছর বয়সে ব্রেন টিউমার অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে দৃষ্টিশক্তি হারাতে হয়। ব্যবসায়ী বাবার সন্তান রূপম অবশ্য এখানকার আবাসিক ছাত্র নয়। মিরপুরের বাসা থেকেই সে আসা-যাওয়া করে। ব্রেইলে দ্বিতীয় শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়েই কোনো স্টিক ছাড়াই দুদ্দাড় করে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে মিউজিক ক্লাসের আকর্ষণে একাই ছুটে নামতে লাগল রূপম।
স্কুলে শিশুদের চলাচল গতিশিক্ষা প্রদানকারী মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বললেন, ‘সাধারণত পঞ্চম শ্রেণীর আগ অবধি আমরা সাদা ছড়ি প্রশিক্ষণ দিই না। আমরা ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক, সিঁড়ি, করিডর, হোস্টেল অবধি যাওয়ার রাস্তা ব্যবহার প্রভৃতি শেখাই। দৃষ্টিশক্তি হারা ছেলেমেয়েরা সাধারণত ঘ্রাণ, স্পর্শ ও শ্রবণশক্তিতে প্রখর হয়। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই বাথরুম ব্যবহার, কাপড় কাচা, খাদ্র গ্রহণ প্রভৃতি কাজ নিজেরাই করতে পারে।’
মিউজিক ক্লাসের শিক্ষক নুসরাত জাহান কুমকুম বললেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের হারমোনিয়াম বাজানো শিখাচ্ছি। তবে আরও হারমোনিয়াম দরকার।’
আমি ফিরে আসার সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিশোরী মেয়েরা দৌড়ে আসে। ওরা মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করছিল। শিক্ষকদের বকায় আবার স্কুলে ঢোকে। আমার গায়ে হাত রেখে বলতে থাকে, ‘আপা, আমাদের চোখ না থাকলেও মনের চোখে আপনারে ঠিকই দেখছি! আমাদের কাছে কেউ আসে না। আপনি কি আবার আসবেন?’
ডাক্তার বা প্রকৌশলী না হতে চেয়ে অমলকান্তি যেমন শুধুই বৃষ্টি শেষের গাছের পাতার রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, প্রকৃতির সন্তান এই দৃষ্টিশক্তিহীন শিশু কিশোর-কিশোরীদের আলোকপথের যাত্রা দেখার অপেক্ষায় যেন থাকতে পারি আমরা সবাই।

No comments

Powered by Blogger.