দেশে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বন্ধ করতে হবে -জঙ্গি তৎপরতার আন্তর্জাতিক জাল

‘ইসলামি জঙ্গি তৎপরতার ব্যাধিটির জন্ম পাকিস্তানের করাচি ও আফগানিস্তানের খোস্তে। এখন তা পাচার হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই সর্বত্র পাকিস্তানি আদল পরিলক্ষিত হবে।’ এ কথাগুলো লেখা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর আগে ২০০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে, পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি টাইমস-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে।
ইসলাম ধর্মের নামে জঙ্গিবাদী তৎপরতার ‘পাকিস্তানি আদল’-এর স্বরূপটা ঠিক কেমন তা স্পষ্ট নয়, তবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ সম্পর্কে প্রকাশিত নানা তথ্য থেকে এটা প্রতীয়মান হয়, ইসলামি জঙ্গিবাদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, যা সে দেশের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।
বুধবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ-সম্পর্কিত এক বিশদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তানসহ সাতটি দেশের জঙ্গিদের তৎপরতা আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটির তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়: ১. বিভিন্ন দেশভিত্তিক এই সংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রয়েছে, তারা কাজ করছে একটি আন্তর্জাতিক জালের মতো। ২. তারা এদেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অর্থ জোগাচ্ছে এবং জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ ছাড়া এদেশীয় জঙ্গিদের অনেকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে গিয়েও প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে। ৩. বিদেশি জঙ্গি নেতাদের অনেকে বাংলাদেশে যাতায়াত করেন, এদেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতাদের আশ্রয়ে বছরের পর বছর বাস করেন। ৪. অনেক বিদেশি জঙ্গি নেতা এ দেশে এনজিও, মাদ্রাসা স্থাপন করেন, অনেকে দেশীয় অনেক মাদ্রাসায় শিক্ষকের চাকরি করেন। অর্থাৎ সেবা সংস্থা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আড়ালে তাঁরা তৎপর থেকেছেন। ৫. জঙ্গিদের সঙ্গে পেশাদার অপরাধীচক্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে; দুবাইভিত্তিক ভারতীয় মাফিয়া দাউদ ইব্রাহিমের চক্রের সঙ্গে এরা যুক্ত। ৬. পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এ দেশে তৎপর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখভাল করে আসছে; জঙ্গিদের সঙ্গে মাফিয়াচক্রের সমন্বয়ের কাজটিও করে আসছে তারা। ৭. বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় জঙ্গি সংগঠনগুলো অনেকটা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পেরেছে; দেশের আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জঙ্গি তৎপরতা দমনে যথেষ্ট তৎপর ছিল না। দেশি-বিদেশি অনেক জঙ্গি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আটক হয়েছে, কিন্তু তাদের অনেককে আইনগতভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। পরে তাদের অনেকেই ছাড়া পেয়েছে, কিন্তু সেসব জঙ্গির আটক বা মুক্তির অনেক খবরই প্রকাশ করা হয়নি। অর্থাৎ বিগত সরকার বা তাদের নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এসব বিষয়ে জনগণের সঙ্গে স্বচ্ছ আচরণ করেনি।
বর্তমান সরকার জঙ্গি তৎপরতা দমনের অঙ্গীকার করেছে, তারা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ ব্যাপারে পুলিশ-র‌্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্রিয়তা বেড়েছে। ইতিমধ্যে অনেক জঙ্গি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে, আস্তানার খোঁজ মিলেছে। গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে এ দেশে জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে এবং সরকারি সূত্রগুলো সেসব তথ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করছে। ফলে জনগণ অনেক কিছু জানতে পারছে, জঙ্গিবাদ সম্পর্কে তাদের সচেতনতা বাড়ছে এবং এতে জঙ্গিবাদী তৎপরতার বিস্তার আগের চেয়ে কঠিন হয়ে উঠবে। জঙ্গিবাদ দমনের অভিযান আরও গতিশীলভাবে চালিয়ে যাওয়া এবং জনগণকে তা সম্পর্কে সব সময় ওয়াকিবহাল রাখার পাশাপাশি এ দেশে তৎপর আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের জালটি ছিন্ন করার সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পাকিস্তান সরকারকে তথ্য-প্রমাণসহ আইএসআইয়ের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে এ দেশ থেকে তাদের গোপন তৎপরতা গুটিয়ে নিতে বলতে হবে। সেই সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা এনজিওর নামে জঙ্গি তৎপরতা এবং বিদেশ থেকে তাদের অর্থের জোগান আসা বন্ধ করতে হবে; মাদ্রাসাগুলোকে যেন দেশি-বিদেশি জঙ্গিরা ব্যবহার করতে না পারেন সেটাও নিশ্চিত করা দরকার।

No comments

Powered by Blogger.