আইলা-পরবর্তী স্থায়ী পুনর্বাসন খুবই প্রয়োজন -দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা by আসাদউল্লাহ খান

২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডরের আঘাতে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলো মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল। সরকারি হিসাবে প্রাণহানির সংখ্যাই ছিল সাড়ে তিন হাজার, বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ সাগরের লোনা পানি ভাসিয়ে নিয়েছিল। সিডরের ক্ষত কাটিয়ে না উঠতেই গত ২৫ মে আইলা নামের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতক্ষীরায় শ্যামনগর এবং খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলা। সরকারি তথ্য মোতাবেক এ পর্যন্ত ১৭৫ জনে প্রাণহানি হয়েছে। বয়স্ক এবং শিশু যারা ভেসে গেছে তাদের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি অঞ্চলের শতকরা আশি ভাগ মানুষ একেবারে হতদরিদ্র বলতে যা বোঝায় তাই। তাদের ঘরবাড়ি সব কাদামাটির তৈরি। মাটির দেয়ালের ওপরে ছন কিংবা গোলপাতার ছাউনি। এবার আইলার আঘাতে মাটির দেয়াল আবার মাটিতে মিশে গেছে। ছিন্নমূল মানুষ এখনো বেড়িবাঁধের ওপরে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে। ছোটখাটো দুই-একটা পয়েন্টে স্বেচ্ছাশ্রম কিংবা সরকারি উদ্যোগে বেড়িবাঁধ মেরামত করা হলেও শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পাতাখালী, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ এবং আশশুনি ইউনিয়নের প্রতাপনগর এলাকায় বেড়িবাঁধের ভাঙন অনেক বড় হওয়ায় জোয়ারের পানি ওঠানামা করছে। সরকারি উদ্যোগে এসব বড় ভাঙন মেরামত করা না হলে জোয়ারের পানি প্রবেশ বন্ধ করা যাবে না। ষাট ও সত্তরের দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে এই বেড়িবাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণকালে উচ্চতা ছিল ১৪ ফুট। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাঁধ অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং কোথাও কোথাও এর উচ্চতা ৮-৯ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিংড়ি ঘেরের কিছু মালিকের অপতৎপরতা। বেড়িবাঁধের অসংখ্য পয়েন্টে নিচ দিয়ে ছিদ্র করে পাইপ ঢুকিয়ে তাদের ঘেরে পানি ঢোকানোর ফলে বাঁধের কাঠামো আরও দুর্বল হয়ে যায়। ফলে বাঁধটি আইলার আঘাতে সহজেই ধসে পড়েছে।
জানা গেছে, এবারের আইলার আঘাতে সাতক্ষীরার ৭০০ কিলোমিটার উকূলীয় বাঁধের ৩৫ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া ২৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। আইলার আঘাতে আটটি স্লুইস গেট নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং ৬১টি অকেজো হয়ে গেছে। আর যত দিন জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হবে ততদিন এ অঞ্চলে কৃষি কাজ থেকে শুরু করে আবাসন নির্মাণ, মাছের ঘের পুনঃস্থাপন কিংবা পুকুরের মত্স্য চাষ, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি প্রতিপালন এবং একই সঙ্গে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
সরকার উপদ্রুত এলাকায় ভিজিএফ কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে আপাতত চালের অভাব হয়তো মিটবে, কিন্তু পুকুরে মাছ নেই, খেতে সবজি নেই, ডাল নেই, তেল নেই, পানি নেই এবং মাথা গোজার ঠাঁইও নেই। এখন প্রয়োজন সব হারানো এসব মানুষের জীবিকার সংস্থান, তাদের কর্মসংস্থানসহ স্থায়ী পুনর্বাসন এবং গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সবচেয়ে ভালো হবে যদি সরকার সেনাবাহিনীর প্রকৌশল শাখার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকদের একটা পরিসখ্যান নিয়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে টিকে থাকতে পারে এমন বাড়িঘর তৈরি করার ব্যবস্থা নেয়।
সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ডিএফআইডি আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাত কোটি পাউন্ডের একটি কর্ম-পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই অর্থ সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে আইলা এবং সিডরে ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসন নির্মাণ এবং সর্বোপরি স্থায়ীভাবে পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেনাবাহিনী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে গঠিত টিমের যৌথ উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় কাজটি করা হলে আবাসন অবকাঠামো টেকসই ও মজবুত হবে এবং সমগ্র প্রক্রিয়াই দুর্নীতিমুক্ত হবে বলে বিশিষ্টজনেরা মনে করেন। জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দুর্যোগ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলকে আঘাত হানতেই থাকবে। তাই ভবিষ্যৎ দুর্যোগের কথা মনে রেখে আরও কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থা হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
সিডরের পরও এটা ঘটেছে এবং এবার আইলার পর দুই মাস কেটে গেলেও এখন মানুষ পানীয় জলের অভাবে খুবই কষ্ট পাচ্ছে। প্রায় ১৬ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে শ্যামনগর, আশাশুনি, দাকোপ প্রভৃতি এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লোনা পানি ঢুকে পড়েছে এবং সমগ্র এলাকার মিঠা পানির পুকুরগুলোর পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সাত লাখ দুর্গত মানুষের জন্য দূর-দুরান্ত থেকে ট্যাংকে পানি এনে সেই, পানি ঘরে ঘরে সরবরাহ করে মাসের পর মাস চলতে পারে না। নলকূপ এখানে কাজ করে না, ১০০ ফুট নিচ পর্যন্ত গেলেও মিঠা পানি পাওয়া যায় না, তাই এ অঞ্চলের লোকেরা বরাবরই বর্ষা মৌসুমে পুকুরে জমা বৃষ্টির পানি পান করে থাকে। এবার বৃষ্টির পরিমাণও অনেক কম।
২০০৬ সালে সুনামি-আক্রান্ত ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের নাগাপুট্টিনাম অঞ্চলে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়। তখন হায়দরাবাদের টাটা প্রকল্প লবণাক্ততা দূর করে ঘণ্টায় সাড়ে তিন হাজার লিটার সুপেয় পানি সরবরাহে সক্ষম চলমান ইঞ্জিন নিয়ে সেখানে হাজির হয়। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলেও এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার।
সবচেয়ে বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে কৃষি কাজ নিয়ে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনো লোনা পানিতে ডুবে আছে। এই লোনা পানি সরে গেলেও এই জমিতে প্রচলিত রোপা আমন ধান চাষ করা যাবে না। এ অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত লবণাক্ততা সহনক্ষম বিআর ৪০ এবং বিআর ৪১ বীজ সরবরাহ করা এ মুহূর্তে একান্ত প্রয়োজন। চাষিদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, এ দুই জাতের ধান বীজের একরপ্রতি ফলনও অনেক বেশি। তবে এলাকা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে জানা গেছে, এই বীজের সরবরাহ এত কম যে কৃষকেরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের জনজীবনকে অনবরত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এটা সাম্প্রতিকালে একটা অনিবার্য নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা অর্থাৎ আবহাওয়া ও জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা ক্রমাগতভাবে জোরদার করতে হবে।
আসাদউল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক
aukhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.