ভারত-তালেবান নতুন ঘনিষ্ঠতার রহস্য যেখানে by আজিজা মুখাম্মেদোভা ও রায়খোনা আবদুল্লায়েভা
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ভারত-আফগান সম্পর্কের ধরন ইতিবাচকভাবে বদলেছে। যদিও ভারত এখনো তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। মিশনকে দূতাবাসে উন্নীত করা মানে স্বীকৃতির প্রস্তুতি নয়, বরং বাস্তবতার নিরিখে সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল। অর্থাৎ ভারত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়েও সর্বোচ্চ মাত্রায় যোগাযোগ ও অংশগ্রহণ বজায় রাখতে চায়।
আফগানিস্তান প্রশ্নে ভারত অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তাকে প্রভাব বিস্তার করার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আফগানিস্তানের জাতীয় পরিসংখ্যান ও তথ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশটির বাণিজ্যে একমাত্র বড় অংশীদার দেশ—যার সঙ্গে সব সময় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকে, সেটি হচ্ছে ভারত।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আফগানিস্তানের উদ্বৃত্ত ছিল ১৪৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ সালে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারে। ওই সময়ে আফগানিস্তান ভারতের কাছে ২৬৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে এবং ৫৯৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।
২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান ভারতের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা পেয়েছে। এমনকি তা চীন, ইরান বা পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। ফলে ভারতের ওপর আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক নির্ভরতা আরও বেড়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ফলে ভারত সেখানে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে পারছে, আবার একই সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্বও বজায় রাখছে। অবকাঠামো বা অর্থনৈতিক প্রকল্পের বাইরে ভারত মানবিক কূটনীতিকেও সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করছে।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত আফগান জনগণের জন্য ধারাবাহিক মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। ভারত বর্তমানে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় মানবিক সহায়তাদাতা দেশ। তাদের সহায়তার মধ্যে ৫০ টন চিকিৎসা সরঞ্জাম, ৬ কোটি ডোজ টিকা, ৪০ হাজার টন গমসহ বিভিন্ন মানবিক সহায়তা রয়েছে।
ভূরাজনৈতিক সমীকরণ
আফগানিস্তানে ভারতের কার্যক্রমের পেছনে মূল প্রেরণা হলো চীন ও পাকিস্তানের মতো অন্যান্য শক্তির প্রভাব সেখানে সীমিত করা। ২০২৫ সালের অক্টোবরে মুত্তাকির ভারত সফরের সময়ই আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা বাড়ে। এ পরিস্থিতি দিল্লিকে সুযোগ দেয় তাদের কূটনৈতিক অবস্থান আরও শক্ত করার।
পরিস্থিতি আরও জটিল দিকে মোড় নেয় ১১ নভেম্বর ইসলামাবাদে আত্মঘাতী হামলার পর, যা তীব্র অবনতি ঘটায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ওই হামলার জন্য ‘ভারতপন্থী গোষ্ঠী’ এবং তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), অর্থাৎ পাকিস্তানি তালেবানকে দায়ী করে। পাকিস্তান বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে আফগান তালেবান টিটিপিকে নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে।
এর আগে গত ৯ অক্টোবর আফগানিস্তান-পাকিস্তান সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ আফগানিস্তানকে ‘ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধি’ বলে মন্তব্য করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও অভিযোগ করেন যে ভারত তালেবানকে ‘উসকে দিচ্ছে’।
এ বাস্তবতা ভারতের জন্য উদ্বেগজনক, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্যের সম্ভাব্য নতুন পুনর্বিন্যাস নিয়ে। এর প্রধান কারণ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। এ সম্পর্কের পেছনে বড় সমর্থন আছে চীনের। চীন কার্যকরভাবে ঢাকা-ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ সমন্বয়কে উৎসাহ দিচ্ছে। ভারতের কাছে এটি একটি সম্ভাব্য ঝুঁকি। কারণ, এই নতুন আঞ্চলিক সমীকরণ দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশেষ করে আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব দুর্বল করতে পারে।
নতুন আঞ্চলিক শক্তিকাঠামো
একই সময়ে চীন পাকিস্তানের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ক আরও গভীর করছে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) এবং ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ (সিপিইসি) প্রকল্পের মাধ্যমে। এসব প্রকল্প দুই দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক সংযোগকে শক্তিশালী করছে এবং পরিবহন-বাণিজ্য রুট থেকে ভারতকে কার্যত বাইরে ঠেলে দিচ্ছে। চীন-পাকিস্তান সহযোগিতা যখন যৌথভাবে একই গন্তব্যের দিকে আগানোর পর্যায়ে চলে যায়, তখন তা ভারতের জন্য ভূ–অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি তৈরি করে।
এই রাজনৈতিক সমীকরণে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গড়ে তোলা আর শুধু প্রভাব বিস্তারের কৌশল নয়। এটি ভারতের জন্য একধরনের বেঁচে থাকার কৌশল, যার মাধ্যমে তারা মধ্য এশিয়ায় প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে চায় এবং চীন-পাকিস্তান অক্ষের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান শক্ত রাখতে চায়।
তবে ভারত ও তালেবানের মধ্যে সহযোগিতা এখনো সীমিতই রয়ে গেছে। নারী অধিকারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ভারত এখনো তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয়। এর একটি প্রতীকী উদাহরণ হলো, ১০ অক্টোবর দুই দেশের মন্ত্রীদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কোনো নারী সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, যা ভারতের গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
স্বল্প মেয়াদে ভারত রাজনৈতিক স্বীকৃতি না দিয়েই আফগানিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও মানবিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাইবে এবং বর্তমান সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের অপেক্ষায় থাকবে। এই অবস্থান ভারতের জন্য ঝুঁকি কমিয়ে আনে, একই সঙ্গে আফগানিস্তানকে তার প্রভাববলয়ের মধ্যে রাখার সুযোগ দেয়।
• আজিজা মুখাম্মেদোভা ও রায়খোনা আবদুল্লায়েভা, ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধীন আফগানিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ গবেষক
- দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
![]() |
| ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। ছবি: রয়টার্স |

No comments