ভারতকে পাশ কাটিয়ে নতুন জোটের চেষ্টা পাকিস্তানের, সফল হবে কি?

আল জাজিরার বিশ্লেষণঃ ভারতকে পাশ কাটিয়ে নতুন একটি দক্ষিণ এশীয় জোট গঠনের চেষ্টা করছে পাকিস্তান। এ উদ্যোগ কতটা সফল হবে তার একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা। দীর্ঘ এ প্রতিবেদনে সাংবাদিক উসেইড সিদ্দিকী বিশ্লেষণ করেছেন নানা দিক নিয়ে। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগটি ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ ও বাইরের অঞ্চলগুলোতে সম্প্রসারিত হতে পারে। বুধবার তিনি ইসলামাবাদে বলেন, আমরা শূন্য-ফলাফলভিত্তিক রাজনীতি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছি। মুখোমুখি অবস্থানের বদলে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর সবসময় জোর দিয়েছি।

প্রকৃত অর্থে, তার এই প্রস্তাব দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন বিকল্প ব্লক তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে যুক্ত হবে চীন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা, রেষারেষি, কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণে প্রায় অচল হয়ে আছে। এমন এক সময়ে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের জীবনের মান-উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেন। তারা বলেন, এই সহযোগিতা ‘কোনো তৃতীয় দেশের বিরুদ্ধে নয়’। ইসহাক দার ওই মন্তব্য করেন এমন এক সময়ে যখন পাকিস্তান-ভারত বিরোধ আবারও চরমে উঠেছে। সম্প্রতি মে মাসে দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে চার দিনের সীমিত আকাশযুদ্ধ উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কও ব্যাপকভাবে খারাপ হয়েছে। তিনি পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে একটি ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন। কিন্তু ভারত তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সার্কের অন্য সদস্য দেশও কি এমন একটি নতুন আঞ্চলিক জোটে যুক্ত হতে রাজি হবে, যেটি মূলত ভারতকে উপেক্ষা বা প্রভাবহীন করার চেষ্টা বলে মনে হয়?

এখানে জানার বিষয়গুলো হলো- পাকিস্তানের প্রস্তাবটি কী?

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো ‘যৌথ স্বার্থের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো’ এবং এই ধারণাকে ভবিষ্যতে ‘আরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে’ সম্প্রসারণ করা। ইসলামাবাদ কনক্লেভে তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তি কিংবা সংযোগ- বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ধাঁচের বহুদেশীয় গ্রুপ তৈরি হতে পারে। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন বা আঞ্চলিক অগ্রাধিকার- কারও অনমনীয়তায় জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না, থাকা উচিতও নয়।’ যা স্পষ্টভাবেই ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ১১ বছর ধরে ভারত-পাকিস্তানের ‘সাজানো-কাঠামোবদ্ধ সংলাপ’ বন্ধ। ভারতের সঙ্গে এ অঞ্চলের অন্য অনেক দেশের সম্পর্ক ‘দোলাচলপূর্ণ’। পাকিস্তানের দৃষ্টিতে, দক্ষিণ এশিয়া হওয়া উচিত এমন একটি অঞ্চল- যেখানে বিভাজনের বদলে সংযোগ গড়ে ওঠে, অর্থনীতিগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়, বিরোধগুলো আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হয়, মর্যাদা রক্ষা করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র সিএসএসপিআরের পরিচালক রাবিয়া আখতার বলেন, এই প্রস্তাব আপাতত ‘বাস্তবায়নের চেয়ে বেশি উচ্চাকাক্সক্ষী’। তবে এটি দেখায় পাকিস্তান দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতার নতুন পথ খুঁজছে এমন সময়ে যখন সার্ক কার্যত স্থবির।

সার্ক কী?
সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে ঢাকায়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য: বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান যোগ দিয়ে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় আটে। সার্কের লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে, দক্ষিণ এশীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা সার্ককে ক্রমাগত অচল করে রেখেছে। স্বাধীনতার পর থেকে দুই দেশ তিনটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করেছে। ২০১৬ সালের ১৯তম সার্ক সম্মেলন ইসলামাবাদে হওয়ার কথা থাকলেও ভারত অংশগ্রহণ না করায় তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়। সিএসএসপিআরের রাবিয়া আখতারের মতে, দুই বৃহত্তম সদস্যের রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সার্ক এগোতে পারে না।

সার্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ?
২০২৫ সালের হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ২ বিলিয়নের বেশি, যা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অত্যন্ত কম-মাত্র ৫ শতাংশ। সে তুলনায় আসিয়ানের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ২৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব, নানা রকম বাধা কমালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ২৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৬৭ বিলিয়ন ডলারে যেতে পারে। বিশেষভাবে ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্য অত্যন্ত দুর্বল। ২০১৭-১৮ সালে মাত্র ২.৪১ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে দুই দেশে। ২০২৪ নাগাদ কমে তা দাঁড়ায় ১.২ বিলিয়ন ডলারে। অফিসিয়াল নয় এমন বাণিজ্য আরও বেশি, প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এ অঞ্চলে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ ব্যবস্থা দুর্বল। এটাই এর অন্যতম প্রধান কারণ। ২০১৪ সালে সার্কভুক্ত গাড়িপণ্যবাহী ট্রাক চলাচলের জন্য একটি মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট হতে যাচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনার কারণে তা আটকে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমিত সহযোগিতা থাকলে সার্ক পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিবেশে তা খুবই কঠিন।

পাকিস্তানের প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর শাহাব এনাম খান বলেন, প্রস্তাবটি উচ্চাকাংখী হলেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দক্ষিণ এশিয়া বহুবার আঞ্চলিক বাস্তববাদী সহযোগিতায় ব্যর্থ হয়েছে, নিরাপত্তা-আবদ্ধ চিন্তাধারায় আটকে থেকেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থি বলেন, সার্কের নীরব মৃত্যু নতুন ফোরামের জন্য শূন্যতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি এবং ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের উষ্ণতা চীন-সমর্থিত ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগকে সম্ভব করেছে। সিএসএসপিআরের রাবিয়া আখতারের মতে, প্রস্তাবটির সফলতা নির্ভর করছে দু’টি বিষয়ের ওপর। তা হলো সম্ভাব্য রাষ্ট্রগুলো ছোট আকারের, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করা জোটে বাস্তব সুবিধা দেখছে কি না। এতে যোগ দিলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের রাজনৈতিক মূল্য তাদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তিনি মনে করেন- শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও সম্ভবত ভুটান প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনায় আগ্রহী হতে পারে। বিশেষ করে সংযোগ, জলবায়ু অভিযোজন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার মতো ইস্যুতে। কিন্তু ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা ও চীন-পাকিস্তান প্রতিযোগিতার কারণে পূর্ণ সদস্যপদ নিতে দেশগুলো খুবই সতর্ক থাকবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের দোন্থির মতামত- এই প্রস্তাব এগোলে ভারত-বাংলাদেশ বৈরিতা আরও বাড়তে পারে এবং ভারতের সঙ্গে চীনের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। এএসপিআইয়ের ফারওয়া আমার মনে করেন, পাকিস্তানের উদ্যোগ ‘কৌশলগত দিক থেকে সুসংগত’। চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। এই ‘ডুয়াল-ট্র্যাক কূটনীতি’ ইসলামাবাদকে আঞ্চলিকভাবে আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে। তিনি বলেন, এটি ইসলামাবাদের প্রচেষ্টা- দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আবারও নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.