গণতান্ত্রিক রূপান্তর: তিউনিসিয়ার অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের নতুন পথচলা
২০১৪ সালের সংবিধানের জন্য আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়িয়েছিল তিউনিসিয়া। আর সেখানে সুশীল সমাজের মধ্যস্থতাকারীরা নোবেল শান্তি পুরস্কারও পান। এসব কথা বলা হয়েছে অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে। এতে বলা হয়, এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে সেই পরীক্ষিত গণতন্ত্র ভেঙে পড়ে। প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়েদ ২০২১ সালে সংসদ স্থগিত করেন এবং একটি নতুন সংবিধান চাপিয়ে দেন, যা সমস্ত ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত করে।
বাহ্যিকভাবে সাফল্যের গল্প মনে হলেও বাস্তবে তিউনিসিয়ার রূপান্তর ছিল কেবল অলংকারসুলভ- যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক করে দেয় যে, গণতান্ত্রিক পথচলায় শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, কার্যকর কাঠামো জরুরি।
তিউনিসিয়ার ফাঁপা বিজয়: তিউনিসিয়ায় ২০১৪ সালের সংবিধান আরব বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর বিষয় ছিল। সেখানে লিঙ্গ সমতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়। শ্রমিক ইউনিয়ন, ব্যবসায়ী সংগঠন, আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টেট দেশটির রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু সাংবিধানিক সৌন্দর্য বাস্তব নীতিতে প্রতিফলিত হয়নি। বিপ্লবের মূল দাবিগুলো- বেকারত্ব দূরীকরণ, দুর্নীতি দমন, সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়গুলো কেবল কাগজে ছিল। বাস্তবে কার্যকর করার কোনও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সবচেয়ে বড় ভুল ছিল রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে অর্থনৈতিক দাবিগুলো উপেক্ষা করা।
আন্তর্জাতিক দাতাদের চাপে তিউনিসিয়া মেনে নেয় কঠোর মিতব্যয়ী নীতি-ভর্তুকি কমানো, সরকারি খাতে মজুরি নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারিকরণ। এর ফলে প্রবৃদ্ধি হঠাৎ কমে যায়, যুব বেকারত্ব এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়তে থাকে।
অন্যদিকে, প্রতিশ্রুত প্রতিষ্ঠানগুলো- সাংবিধানিক আদালত, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রায় সবই থেকে যায় কাগজে-কলমে। পুরোনো স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো নতুন কাঠামোর ভেতরেও টিকে যায়। ফলে সাধারণ মানুষ নতুন ব্যবস্থাকে আগের মতোই ভেদ করতে শিখে ফেলে- সংযোগ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে, অধিকার নয়।
বাংলাদেশের সমান্তরাল চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশের জুলাই-উত্থানও একইসঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বস্তির দাবি তুলে ধরে। তিউনিসিয়ার মতো এখানেও পুরোনো স্বার্থগোষ্ঠী আছে। তারা ভূমি, লজিস্টিকস ও সরকারি ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। তবে বাংলাদেশের কিছু সুবিধাও আছে। অর্থনীতি তুলনামূলক বড় এবং বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের মাধ্যমে। এখাতে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। গত দুই দশকে শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু হ্রাস এবং নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যও আছে বাংলাদেশের। তবু ভঙ্গুরতাও আছে। সীমিত রপ্তানি খাত, জ্বালানি দামের ঝুঁকি, দুর্বল আর্থিক খাতের শাসনব্যবস্থা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের আধিক্য। শহুরে জীবিকা মুদ্রাস্ফীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত, আর যুব বেকারত্ব ক্রমবর্ধমান- যে অবস্থা তিউনিসিয়ার মতো হতাশা তৈরি করতে পারে।
তিউনিসিয়ার ভুল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বাংলাদেশের সামনে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার রয়েছে। তা হলো- দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি: জনগণ যদি পরিবর্তনের সুফল না পায়, গণতন্ত্র ভঙ্গুর হয়। তাই দরিদ্রদের জন্য নগদ সহায়তা, নিম্নআয়ের শ্রমিকদের মজুরি ভর্তুকি, শ্রমঘন জনপদ প্রকল্প এবং স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ-গ্যাস নিশ্চিত করা জরুরি। তিউনিসিয়া উল্টো কাজ করেছিল- আগে কৃচ্ছ্রনীতি, পরে প্রতিশ্রুতি।
কাঠামোগত সংস্কার: শুধু নতুন মুখ নয়, দরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন। স্বচ্ছ ই-প্রকিউরমেন্ট, সরকারি ঠিকাদারদের প্রকৃত মালিকানা নিবন্ধন, প্রতিযোগিতা কমিশনকে ক্ষমতায়ন এবং ডিজিটাল ভূমি রেকর্ড দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করবে।
প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার: তিউনিসিয়া নোবেল পেলেও সাংবিধানিক আদালত তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশকে প্রথমেই বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনে জোর দিতে হবে।
আর্থিক সংস্কারের ধাপ: কৃচ্ছ্রনীতি প্রয়োগের আগে দরিদ্রদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা, ডিজিটাল কর-ব্যবস্থা এবং ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনায় ধাপে ধাপে শর্ত গ্রহণ করা দরকার।
স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধ: স্বৈরশাসন প্রায়শই দক্ষতার নামে ফিরে আসে। তাই প্রয়োজন শক্তিশালী বিচারিক পর্যালোচনা, সংসদীয় কমিটির তদন্ত ক্ষমতা, প্রকৃত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সক্রিয় সুশীল সমাজ।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক গুরুত্ব: ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এটি বিশ্বের দ্বিতীয়, আর এর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন, শ্রম অভিবাসন ও জলবায়ু অর্থায়নে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া তিউনিসিয়ার পতন নীতিনির্ধারকদের মাঝে এই ধারণা জোরদার করেছে যে গণতন্ত্র উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিলাসিতা। কিন্তু যদি বাংলাদেশ রাজনৈতিক অধিকার, কর্মসংস্থান ও ন্যায়বিচার একসঙ্গে সরবরাহ করতে পারে, তবে এটি সেই ধারণার জবাব হতে পারে বাস্তব প্রমাণ দিয়ে।
মর্যাদার পরীক্ষা: তিউনিসিয়ার বিপর্যয়ের মূল কারণ ছিল বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রের দৈনন্দিন অবমাননা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হওয়া। যখন গণতন্ত্র কেবল উচ্চমূল্য আর ধীর সেবা হিসেবে দেখা দিল, তখন জনগণ একে অভিজাতদের হাতিয়ার মনে করল।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একই পরীক্ষা: গণতন্ত্র কি একজন পোশাকশ্রমিকের চাকরি রক্ষা করবে? একজন কৃষক কি মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া ন্যায্য দাম পাবে? একজন সাংবাদিক কি নির্ভয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন? এসব অর্জনই টেকসই গণতন্ত্রের মাপকাঠি। বিশ্ব প্রশংসা করবে যদি বাংলাদেশ সুষ্ঠু নির্বাচন করে বা চমৎকার আইন পাস করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য আসবে তখনই, যখন মানুষ টেবিলে খাবার, কাজে মর্যাদা ও বিচার পাবে। তিউনিসিয়ার ফাঁপা বসন্ত বাংলাদেশের হতাশ শীতে রূপ নেবে না- যদি ঢাকা ‘মর্যাদা’কেই গণতান্ত্রিক সাফল্যের আসল মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে।

No comments