জেলেনস্কি প্রশাসনের দুর্নীতি এখন পশ্চিমাদের যুদ্ধ ছাড়ার পথ by লিওনিদ রাগোজিন
এই তদন্ত পরিচালনা করছে ইউক্রেনের ন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন ব্যুরো, যা পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত একটি সংস্থা। ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ আন্দ্রি ইয়েরমাকও এই চক্রে জড়িত থাকতে পারেন।
এই কেলেঙ্কারি জেলেনস্কির আন্তর্জাতিক সুনাম এবং সামগ্রিকভাবে ইউক্রেনের অবস্থানকে বড় ধরনের আঘাত করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে এখন মনে হচ্ছে অন্য কারও ইশারায় নাচা পুতুলের মতো। পর্দার আড়াল থেকে যাকে নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য কেউ। সেই নিয়ন্ত্রক যে কেউ হতে পারে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনও।
রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় ইউক্রেনের নীতিতে ইতিমধ্যেই নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার দায়িত্বে আছেন দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই কিসলিৎসিয়ার।
১১ নভেম্বর তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টাইমস। তিনি সেখানে স্পষ্ট জানান যে আলোচনায় কোনো ফল না আসায় মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহ পরই জেলেনস্কি ঘোষণা করেন, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে চান।
এরপরই কথা উঠতে থাকে উদীয়মান মার্কিন শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে। গণমাধ্যমের ফাঁস হওয়া তথ্যমতে, যা মূলত যুদ্ধের অবসানের জন্য রাশিয়ার সব প্রধান দাবি মেনে নেওয়ার প্রস্তাব। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের এর বিরুদ্ধে অবস্থান সত্ত্বেও জেলেনস্কি ওই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুর্নীতি কেলেঙ্কারি তার প্রতিবাদ জানানোর ক্ষমতা সীমিত করে দিয়েছে।
এখন শান্তির সম্ভাবনা আরও বাস্তবসম্মত বলে মনে হচ্ছে। কারণ, ইউক্রেনের সম্ভাব্য পরাজয়ের জন্য এখন একটি স্পষ্ট বলির পাঁঠা পাওয়া গেছে। সেই বলির পাঁঠা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নিজেই।
এ বছরের শুরুর দিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে আলোচনাগুলো তেমন অগ্রসর হয়নি। কারণ, কেউই এমন ফলাফলের দায় নিতে চায়নি, যা যুদ্ধের সমর্থকদের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত। সামরিক পরাজয় কিয়েভের জন্য মুক্তির পথ হতে পারে, কিন্তু এটি হবে সেসব যুদ্ধপন্থী রাজনীতিবিদ ও লবি গোষ্ঠীর জন্য ভয়াবহ আঘাত। কারণ, তারা মনে করেছিল রাশিয়ার মতো পরমাণু শক্তিধর দেশকে বল প্রয়োগ করে পশ্চিমা আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য করা যাবে। এই ভ্রান্ত ধারণাই সংঘাতজুড়ে রাশিয়া সম্পর্কে পশ্চিমা নীতির ভিত্তি ছিল।
অনেক দিন ধরেই স্পষ্ট যে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা সামরিক সহায়তা, অর্থায়ন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে একপ্রকার ‘দেয়ালে’ দিয়ে ঠেকেছে। অর্থাৎ আর এগোনো তাদের পক্ষে কঠিন। মস্কোর বিরুদ্ধে আরোপিত উনিশ দফা কঠোর নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর সময়ের তুলনায় রুশ সেনাবাহিনী এখন আরও শক্তিশালী এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত।
অন্যদিকে ইউক্রেন ভুগছে সামরিক পরিকল্পনাহীনতা, ভূখণ্ড হারানো এবং জনবল ক্ষতির কারণে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেন আগামী এপ্রিলের মধ্যেই পশ্চিমা অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়তে পারে। আরও খারাপ খবর হলো দেশটির ঘনিষ্ঠ ইউরোপীয় মিত্ররা ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা বিপুলসংখ্যক ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের খরচ বহন করতে প্রস্তুত নয়।
ইউরোপে রাশিয়ার সঙ্গে আরও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ অনেকটাই শেষ। তবুও এমন একটি অপ্রত্যাশিত সমঝোতায় পৌঁছানোর দায় কেউই নিতে চায় না, যা এই যুদ্ধ ছাড়াও অর্জন করা যেত।
ইউক্রেনের পরাজয়ের দায় নেওয়া ট্রাম্পের জন্য খুব বড় ঝুঁকি নয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এই সংঘাতকে ‘বাইডেনের যুদ্ধ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ইউরোপীয় নেতাদের জন্য আর জেলেনস্কির নিজের জন্য এটি মেনে নেওয়া অনেক বেশি কঠিন। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এসেছেন যে রাশিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করা সম্ভব।
আজকের পরিস্থিতি বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরর, যখন প্যারিসে জেলেনস্কি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ওই বৈঠকে দুই পক্ষ পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, যার ফলে পরবর্তী ১২ মাসে লড়াই বন্ধ থাকে এবং ফ্রন্টলাইনও স্থির হয়ে যায়।
সেই সময়ই যুদ্ধ এমন শর্তে শেষ হতে পারত, যা আজ কিয়েভ জন্য কেবলই স্বপ্ন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাইডেন হোয়াইট হাউসে আসার পর জেলেনস্কি হঠাৎ শান্তি প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেন।
জেলেনস্কি ইউক্রেনে পুতিনের প্রধান রাজনৈতিক মিত্রের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালান এবং ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে জোরালো প্রচারণা শুরু করেন। তাঁর পশ্চিমা মিত্ররা জার্মানিকে নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন, যা রাশিয়ার একটি বড় জ্বালানি রপ্তানি প্রকল্প, তা বন্ধ করতে চাপ দিতে থাকে। লন্ডনও ক্রিমিয়ার উপকূলে (যা রাশিয়া নিজের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে) একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে মস্কোকে চ্যালেঞ্জ করে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই বিপজ্জনক ‘ব্রিঙ্কম্যানশিপ’ বা সংঘর্ষের সীমানায় দাঁড়িয়ে চালানো উত্তেজনার রাজনীতি শেষ হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন পুতিন ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন।
এ বছরে ইউক্রেন একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির দাবিতে ফিরে আসে। আর এটি করতে হয়েছে ইউক্রেনকে বিপুল ভূখণ্ড, অনেক অবকাঠামো, সাড়ে ১৪ হাজার সাধারণ নাগরিক এবং প্রায় ১ লাখ সামরিক সদস্য হারানোর পর।
রাশিয়ার শর্তে শান্তিচুক্তি করা ইউক্রেনের জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত অন্যায় হবে এবং আন্তর্জাতিক আইনবিরোধীও। কিন্তু এর একমাত্র বিকল্প হলো দেশটি আরও গভীরভাবে ধ্বংসের গহ্বরে ডুবে যাওয়া এবং রাষ্ট্র হিসেবে ভেঙে পড়া।
শান্তি পরিকল্পনার খসড়ার প্রতি প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিত। তা ছিল কিছুটা নৈতিকতার প্রদর্শন, অভিনয়সুলভ প্রতিবাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদী সুরের মিশ্রণ। তবে এতে ছিল না বাস্তবসম্মত কোনো পরিকল্পনা, যা ইউক্রেনের আলোচনার অবস্থানকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করতে পারত।
এখন জেলেনস্কির ঘনিষ্ঠমহলের দুর্নীতি পশ্চিমে ইউক্রেনপন্থী সমর্থকদের জন্য একটি ‘পালানোর পথ’ তৈরি করেছে। এই পালানোর পথ তাদের যুদ্ধের ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় থেকে মুক্তি দেবে, অথচ এই বিপর্যয় সৃষ্টিতে তারাও ছিল সমানভাবে দায়ী।
• লিওনিদ রাগোজিন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
- আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
![]() |
| ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: রয়টার্স |

No comments