ওয়াশিংটন সফরে বড় জয় হাতিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান by মোহাম্মদ এলমাসরি

যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ নভেম্বর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সফরটি হোয়াইট হাউসের কূটনৈতিক সফর-ইতিহাসে সবচেয়ে নজরকাড়া সফরগুলোর একটি হয়ে থাকল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মোহাম্মদ বিন সালমানকে আক্ষরিক অর্থেই রাজকীয় অভ্যর্থনা দিয়েছেন। মেরিন ব্যান্ডের সংগীত, অশ্বারোহী বাহিনীর কুচকাওয়াজ, সামরিক বিমান উড্ডয়ন প্রদর্শনী, ২১ বার তোপধ্বনি—সবই ছিল তাঁর জন্য। কিন্তু এসব আনুষ্ঠানিকতার বাইরে ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা।

এটি ছিল যুবরাজের ২০১৮ সালের অক্টোবরে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা ও তাঁর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করার ঘটনার পর প্রথম ওয়াশিংটন সফর। সে ঘটনার কারণে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছিলেন।

এ সফরের মাধ্যমে ওয়াশিংটনে ‘খাসোগি অধ্যায়’ কার্যত বন্ধ হলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরে এল।

বৈঠকটি সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন দিক নির্দেশ করল। দুই দেশ এমন এক পর্যায়ের সহযোগিতায় সম্মত হলো, যা ভবিষ্যতে তাদের শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।

বৈঠক থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে।

আদতে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর যে কূটনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, এ বৈঠক তা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করল।

যুবরাজ সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করলেও ঘটনাটির সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করা হয়েছিল। সিআইএর তদন্তে বলা হয়েছিল, সালমান ব্যক্তিগতভাবে এ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

২০১৯ সালের মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণায় জো বাইডেন বলেছিলেন, তিনি সৌদিদের ‘যে ধরনের একঘরে হওয়া উচিত, সে রকমই করবেন’ এবং খাসোগি হত্যার জন্য তাঁদের ‘মূল্য দিতে বাধ্য করবেন’।

কিন্তু পরে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সৌদিদের খুব বেশি চাপে রাখেনি। সম্ভবত ওয়াশিংটনের কৌশলগত হিসাব হলো, সৌদি আরবকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

মঙ্গলবারের যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে একটি মুহূর্ত বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো ছিল। এবিসি নিউজের সাংবাদিক ম্যারি ব্রুস খাসোগি প্রসঙ্গে সরাসরি যুবরাজকে প্রশ্ন করেন।

ট্রাম্প সঙ্গে সঙ্গে মাঝখান থেকে বাধা দিয়ে তাঁর হয়ে উত্তর দিতে শুরু করেন। তিনি এবিসিকে ‘ফেক নিউজ’ বলেন এবং চ্যানেলটিকে সাংবাদিকতার সবচেয়ে খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বলে আখ্যা দেন।

ট্রাম্প দাবি করেন, খাসোগি ‘খুব বিতর্কিত ব্যক্তি’ ছিলেন এবং ‘অনেকেই তাঁকে পছন্দ করতেন না’।

হত্যা প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটে, কিন্তু (যুবরাজ) এর কিছুই জানতেন না। পরে তিনি ব্রুসকে ‘ভয়ংকর মানুষ’ এবং ‘ভয়ংকর রিপোর্টার’ বলেও আক্রমণ করেন।

ট্রাম্পের এ প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের দৃষ্টিতে খাসোগি হত্যার বিষয়টি এখন ইতিহাসের পুরোনো ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মঙ্গলবারের সফরের আগেই ওয়াল স্ট্রিট থেকে শুরু করে হলিউড পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সৌদির অর্থ প্রবাহিত ছিল। তবে এবার সেই অর্থ আরও ব্যাপকভাবে বাড়বে।

গত মে মাসে মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। মঙ্গলবার তিনি সেই অঙ্ক বাড়িয়ে এক ট্রিলিয়ন ডলার করার ঘোষণা দেন। এতে ট্রাম্প খুবই খুশি হন।

এ বিনিয়োগ ট্রাম্পকে ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে বড় সহায়তা করতে পারে।

এক ট্রিলিয়ন ডলার প্রায় সেই অঙ্কের সমান, যা যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আট বছরের যুদ্ধে খরচ করেছিল। এ কারণে এটি মার্কিন কোম্পানিগুলোকেও বড় ধরনের সুবিধা দেবে।
ট্রাম্প মনে করেন, এসব বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রে ‘অনেক চাকরি’ তৈরি হবে।

তবে এত বিশাল বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি শক্তির ভারসাম্যে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনবে।

দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র সৌদির ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারত। কিন্তু সৌদির এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এত বড় প্রভাব তৈরি হওয়ায় সেই ভারসাম্য সৌদির দিকেই ঝুঁকছে।

এ বিনিয়োগের মাধ্যমে যুবরাজ কার্যত রাজনৈতিক প্রভাবই কিনে ফেলেছেন। যে খাতগুলোর ব্যবসা সৌদির অর্থে চলবে, তারা ভবিষ্যতে মার্কিন সরকারে সৌদির পক্ষে লবিং করবে।

এ বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সৌদির মানবাধিকার লঙ্ঘন বা অন্যান্য নীতি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা (এআই) ও পারমাণবিক শক্তিতে সৌদির বিনিয়োগ তাদের বিশ্ব ও আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াবে। মোহাম্মদ বিন সালমান বহুদিন ধরে উন্নতমানের কম্পিউটার চিপ কিনতে চেয়েছেন, যাতে রাষ্ট্রীয় এআই প্রতিষ্ঠান হিউমেইন বৃহৎ ডেটা সেন্টার চালাতে পারে।

বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বড় পরিমাণে চিপ বিক্রির অনুমোদন দেবে। এই চিপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিজ্ঞান সৌদিকে যে ক্ষমতা দেবে, তাতে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। কারণ, ইউএই-ও বৈশ্বিক এআইয়ের কেন্দ্র হতে চায়। ইউএই সম্প্রতি এনভিডিয়ার কাছ থেকে কয়েক লাখ এআই চিপ কেনার চুক্তি করেছে।

যুবরাজ ও ট্রাম্প একটি পারমাণবিক চুক্তিও সই করেছেন। এ চুক্তি সৌদির বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিকে অনেক এগিয়ে নিতে পারে। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, উপকরণ ও দক্ষতা চাইছে, যাতে তারা ইরান ও ইউএইর পারমাণবিক সক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।

২০২৩ সালে সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুলআজিজ বিন সালমান বলেন, তাঁদের লক্ষ্য ‘সম্পূর্ণ পারমাণবিক জ্বালানি চক্র’। এর মধ্যে ইয়েলোকেক উৎপাদন, কম মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি এবং পারমাণবিক জ্বালানি প্রস্তুত করা—সবই রয়েছে।

চুক্তির বিস্তারিত পরে জানানো হবে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদিকে নিজস্ব ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির অনুমতি দেবে কি না বা ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ১২৩ অ্যাগ্রিমেন্ট’ মানতে বলবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সব মিলিয়ে সৌদি আরব ও যুবরাজের জন্য এটি বড় জয়।
মঙ্গলবার যুবরাজ যে সাফল্যগুলো পেয়েছেন, এর মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতের অর্জন সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্প সৌদি আরবকে ‘মেজর নন-ন্যাটো অ্যালাই’ (এমএনএনএ) ঘোষণা করেছেন এবং একটি মার্কিন-সৌদি কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তিতে (এসডিএ) সই করেছেন।

এই প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্ভবত কাতারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের করা চুক্তির মতো হবে। যদিও সৌদি আরব আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি রক্ষা করতে বাধ্য হবে কি না, তা এখনো জানা যায়নি।

সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, যুবরাজ ও ট্রাম্প এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিতেও পৌঁছেছেন।

এফ-৩৫ বিক্রি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। কারণ, মার্কিন আইন অনুযায়ী, যেকোনো চুক্তির আগে যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়, সব আরব ও মুসলিম দেশের তুলনায় ইসরায়েলের ‘গুণগত সামরিক সুবিধা’ বজায় রাখা হবে। আরেকটি উদ্বেগ হলো, এই প্রযুক্তি চীনের হাতে চলে যেতে পারে।

এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে শুধু ইসরায়েলই এফ-৩৫ ব্যবহার করে। সৌদি আরব এ ধরনের ৪৮টি জেট চায়, যা কিনা ইসরায়েলের হাতে থাকা এফ-৩৫ বিমানের সংখ্যার চেয়ে বেশি।

যদিও আগে খবর এসেছিল, সৌদির এফ-৩৫-এর সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হবে, যাতে ইসরায়েলের সুবিধা বজায় থাকে। তবে ট্রাম্প মঙ্গলবার বলেছেন, সৌদি বিমানগুলো হবে ‘টপ অব দ্য লাইন’, অর্থাৎ মানের দিক থেকে সেগুলো হবে সর্বোচ্চ।

এমএনএনএ মর্যাদা, প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং এফ-৩৫ কেনা—সব মিলিয়ে সৌদির প্রতিরক্ষা শক্তি অনেক বেড়ে যাবে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে।

ইসরায়েল এ অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসেবে থাকবে, কিন্তু সৌদি আরব সেই ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ফেলবে এবং ইরানসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে।

* মোহাম্মদ এলমাসরি, দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডির মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক।
- মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মোহাম্মদ বিন সালমান
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.