খারাপ চুক্তি, নয়তো আরও যুদ্ধ—মহাসংকটে জেলেনস্কি

সিএনএন বিশ্লেষণঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধে ২৮ দফার শান্তিচুক্তিতে সম্মতি দেওয়ার জন্য ইউক্রেনকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিয়েভের ইউরোপীয় মিত্রদের চাপের মুখে ট্রাম্প তা থেকে সরে এসেছেন। এরই মধ্যে ইউরোপীয়রা একটি পাল্টা শান্তি প্রস্তাব দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে চলছে নিবিড় কূটনৈতিক দর-কষাকষি।

কিন্তু যতই দর-কষাকষি হোক, দিন শেষে যে চুক্তি হবে, তা ইউক্রেনের পক্ষে যাবে না। আর কিয়েভ যদি এই ‘খারাপ চুক্তিতে’ রাজি না হয়, তাহলে তাকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইউক্রেন কত দিন রাশিয়ার সেনাদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, তা যথেষ্ট শঙ্কার বিষয়।

দর-কষাকষির জন্য ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ আবারও শিগগির মস্কো সফরে যাবেন। সফরে পুতিনসহ রাশিয়ার অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথা রয়েছে। উইটকফের এবারের সফরের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য সম্ভবত ইউক্রেনের ভূমি ছাড়ের বিষয়ে রাশিয়াকে ছাড় দিতে রাজি করানো। বিশেষ করে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্কের দাবি ছেড়ে দিতে মস্কোকে সম্মত করা। রাশিয়া এটা ছাড়তে রাজি হবে কি না, তা কিছুদিনের মধ্যে স্পষ্ট হবে।

ইউক্রেনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুরোদমে হামলা শুরু করে রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেনের পূর্ব দিকের দনবাস অঞ্চলে মূলত ২০১৪ সাল থেকে সরকারি সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘাত চলছে। বিদ্রোহীদের সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক—এই দুই প্রশাসনিক অঞ্চল নিয়ে দনবাস গঠিত। লুহানস্কের প্রায় পুরোটা রুশ সেনারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। দোনেৎস্কের অধিকাংশ অঞ্চলও রুশ সেনাদের দখলে। শান্তিচুক্তির জন্য রাশিয়ার অন্যতম প্রধান দাবি, দনবাসের পুরোটা রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। বিনিময়ে ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চলের দখলকৃত ভূখণ্ড ছাড়বে রাশিয়া।

যুদ্ধের এই পর্যায়ে ইউক্রেনের আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। বর্তমানে রণক্ষেত্রের পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবেও নানা সমস্যায় জর্জরিত ইউক্রেন। আজ শুক্রবার দুর্নীতি তদন্তকারীরা ইউক্রেনের চিফ অব স্টাফ ও প্রধান আলোচক আন্দ্রিয় ইয়ারমাকের বাড়ি তল্লাশি করেছেন। মার্কিন শান্তি প্রস্তাব মেনে যুদ্ধ বন্ধ করা নিয়ে চাপে থাকা জেলেনস্কি প্রশাসনের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা।

এদিকে রণক্ষেত্রে ইউক্রেনের বড় সংকটগুলোর মধ্যে সেনা সংখ্যার ঘাটতি অন্যতম। তা ছাড়া কিয়েভ আগামী বছর ইউরোপীয় মিত্রদের থেকে কতটুকু তহবিল পাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

এসব সংকটের পাশাপাশি রণক্ষেত্রে ইউক্রেন বর্তমানে তিনটি পৃথক প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে। রুশ সেনারা জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। ধীর হলেও পোক্রোভস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলেও রুশ সেনাদের গতি অব্যাহত রয়েছে। উত্তর দিকের কুপিয়ানস্ক অঞ্চলেও রুশ সেনারা শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। একসঙ্গে এতগুলো অঞ্চলে রুশ সেনাদের অগ্রগতি থামানোর সামর্থ্য জনবল-ঘাটতিতে থাকা ইউক্রেনের নেই। এ নাজুক অবস্থায় চলতি শীতে দোনেৎস্কের যেসব অঞ্চল এখনো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা-ও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।

শুধু তা-ই নয়, রুশ সেনারা ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্র ক্রামাতোরস্কের বেশ কাছে চলে এসেছেন। তাঁরা সেখানে এখন স্বল্পপাল্লার ড্রোন দিয়ে নিয়মিতভাবে হামলা চালাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে হারানো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনের সেনারা সহজে নিতে পারবেন, এমন কোনো সম্ভাবনা নেই; বরং এখন কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের মূল চাওয়া, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে রাশিয়া অস্থিতিশীল হয়ে পড়ুক।

কিয়েভ ও তার মিত্রদের আরেকটি গোপন আশা, যত বেশি সম্ভব রুশ সেনাদের প্রাণহানি এবং যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া যে অর্থনীতি গড়ে তুলেছে, তা ভেঙে পড়ুক। এ চাওয়া সম্ভবত বেশ দুর্বল। কারণ, রাশিয়ার মতো একটি আবদ্ধ সমাজ এসব চাপে কতটা ভেঙে পড়বে, তা পূর্বাভাস করা প্রায় অসম্ভব।

২০২৩ সালের রাশিয়ার ভাড়াটে বেসরকারি সামরিক বাহিনী ‘ওয়াগনার’ বিদ্রোহ করেছিল। রণক্ষেত্র থেকে বাহিনীটির সেনারা বিদ্রোহ করে মস্কোর দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এ বিদ্রোহ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছিল। বাহিনীর প্রধান ইভগেনি প্রিগোশিন বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন।

তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বলা যায়, জেলেনস্কির কাছে এখন দর-কষাকষির তেমন সুযোগ নেই। অন্যদিকে গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বলা যায়, একটি চুক্তি প্রায় আসন্ন। এখন ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে চুক্তি করা বা বড় ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই জেলেনস্কির। অন্যদিকে মস্কোয় রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে উইটকফের আসন্ন আলোচনা শেষে শান্তি প্রস্তাব মেনে নিতে ট্রাম্প ইউক্রেনকে হয়তো আরেকটি সময়সীমা বেঁধে দেবেন।

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-11-28%2Foxavz1v0%2FAS3656042724.JPG?rect=0%2C0%2C1202%2C801&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এখন এক অচিন্তনীয় শান্তি প্রস্তাবের মুখোমুখি। ফাইল ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.