বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রায় ও আসন্ন গণভোটে দক্ষিণ এশিয়ায় পালাবদলের ইঙ্গিত by নাজাম লায়লা
এ রায় কেবলই একটি রাজনৈতিক পরিবারের পতনকেই সামনে আনেনি; বরং বাংলাদেশের আসন্ন গণভোট ও নির্বাচন মিলে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির একটি ফাটলের ইঙ্গিত দেয় এবং একই সঙ্গে সম্ভাব্য আরও বহুকেন্দ্রিক আঞ্চলিক ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ ভারতের ওপর কম নির্ভরশীল থাকবে। পালাবদলের এ মুহূর্ত বাংলাদেশকে একটি প্রান্তিক শক্তি থেকে দ্বিধাবিভক্ত অঞ্চলটিতে স্থিতিশীল একটি শক্তি হিসেবে রূপান্তর করতে পারে।
নতুন কুশীলব, নতুন মেরুকরণ
‘বর্ষা বিপ্লব’ শুধু শেখ হাসিনার সরকারের পতনই ঘটায়নি; বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর দল আওয়ামী লীগ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) যে কয়েক দশকের পুরোনো দ্বিদলীয় আধিপত্য ছিল, সেটাও ভেঙে দিয়েছে। বিপ্লবের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের এই সময়ে এ সরকার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এ পরিবর্তন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক কুশীলবদের জন্য জায়গা তৈরি করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে ছাত্র-বিপ্লবীদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং শেখ হাসিনার সরকার আমলে নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী। দলটি শিবির নামে পরিচিত নিজেদের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ পুনরুত্থান উপভোগ করছে।
নিজেদের একটি মধ্যপন্থী ও বহুত্ববাদী শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা এনসিপি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও একটি নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও দলটির যে জনপ্রিয়তা, তা মূলত পরিবারন্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির প্রতি গণ–অসন্তোষেরই বহিঃপ্রকাশ। জামায়াত নিজেদের একটি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে নতুন করে পরিচয় করাচ্ছে। দলটি অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কার এজেন্ডাকে প্রভাবিত করতে এবং সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) জন্য চাপ তৈরিতে এনসিপির সঙ্গে অভিন্ন অবস্থান নেয়।
সন্ত্রাস দমন আইনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। গত রোববার শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা বাংলাদেশে নির্বাচন রুখে দিতে চাইবে এবং নির্বাচনের আগে সহিংসতারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে দলের নেতাদের মধ্যে অনৈক্য এবং দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে, যদিও দলটি এ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা)’ নীতির কথা বলে আসছে। কিছু বিশ্লেষণে বিএনপিকে নির্বাচনের সম্ভাব্য বিজয়ী দল হিসেবে দেখানো হলেও এখনই নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ কঠিন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয় জামায়াতের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে, যদিও এই সাফল্য জাতীয় পর্যায়ে না–ও দেখা যেতে পারে।
জুলাই সনদ গণভোট
ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে গণভোটটি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব করা সংস্কারের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। গত অক্টোবরে বিএনপি, জামায়াতসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল এতে স্বাক্ষর করে।
এটি বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে অভূতপূর্ব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে একত্র করেছে। সনদে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর জন্য মেয়াদসীমা, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব–ব্যবস্থা এবং ২০২৪ সালের গণ–আন্দোলনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এতে নির্বাহী ক্ষমতার ওপর আরও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও সংসদীয় প্রভাব বা একচ্ছত্র আধিপত্য ঠেকানোর সুরক্ষাব্যবস্থাও যুক্ত করা হয়েছে।
গণভোটে অনুমোদন পেলে এসব পরিবর্তন দশকের পর দশকের বংশানুক্রমিক আধিপত্য ভেঙে দিয়ে বহুত্ববাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে। তবে সংস্কারের সময়সূচি, পরিধি ও বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো মতপার্থক্য রয়ে গেছে, যার নিষ্পত্তি গণভোটের পরই হবে। উদাহরণস্বরূপ এনসিপি বলেছে, সরকার সংস্কারগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, তা স্পষ্ট করলেই কেবল তারা সনদে স্বাক্ষর করবে।
গণভোটে জোরালো জনসমর্থন পাওয়া গেলে ও সঠিক আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করে স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি এমন একটি ক্ষমতার ভারসাম্য গড়ে তুলতে পারে, যা শেখ হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য নিশ্চিত করতে পারে। এতে বাংলাদেশ একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরি করতে পারবে এবং আরও কার্যকরভাবে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে যদি বাংলাদেশিরা ‘না’ ভোট দেন, তাহলে নির্বাচনে যে–ই জিতুক না কেন, তাদের জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকতে হবে না। ফলে ঐক্যবদ্ধ সংস্কারের এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
আঞ্চলিক প্রভাব
নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাবের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের ভারতনির্ভরতা—যা হাসিনা যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল—কমাতে কাজ করছে এবং বৈদেশিক সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বেড়েছে। কারণ, দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও নয়াদিল্লি হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ উপেক্ষা করেছে। এই পরিবর্তন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পরও চলতে পারে। কারণ, নির্বাচনে যেসব দল মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকবে, সেগুলোর প্রায় সব দলই ভারতের সমালোচক, যা জনমতের মধ্যে বিরাজমান একধরনের ভারতবিরোধী মনোভাবকে প্রতিফলিত করে। এর পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে হাসিনা সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের সমর্থন। নয়াদিল্লি বলেছে, তারা বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং এ লক্ষ্য অর্জনে সব সময় গঠনমূলকভাবে সব অংশীজনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ককে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করছে। প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য—এ তিন ক্ষেত্রেই চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা ও চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। গত মার্চ মাসে অধ্যাপক ইউনূস বেইজিংয়ের সঙ্গে বড় ধরনের সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শুরু করে রেলপথ, ডিজিটাল অবকাঠামোসহ ৩০টির বেশি বড় প্রকল্পে ছড়িয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ডেনমার্কের বৈশ্বিক টার্মিনাল অপারেটর এপিএম টার্মিনালস থেকে রেকর্ড ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ পেতে যাচ্ছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক ইউরোপীয় বিনিয়োগ। সব মিলিয়ে বর্ষা বিপ্লবের পর এক বছরে বাংলাদেশের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে সাত দেশের আঞ্চলিক জোট বিমসটেকের চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। অন্তর্বর্তী সরকার আসিয়ানেও যোগ দিতে চাইছে এবং সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে পাকিস্তানের সঙ্গে সার্ক পুনরুজ্জীবনের বিষয়েও কথা বলেছে। ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাতে জর্জরিত দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য এসব পদক্ষেপ বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্পর্ক ও বহুপক্ষীয়তার একটি শক্তিশালী মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
পরিবর্তনের মুহূর্ত
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর হাসিনাপরবর্তী যুগে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হবে অন্তর্বর্তী সরকারের উত্তরাধিকার ধরে রাখা, যা বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক পর্যায়ে অন্যের খেলায় ব্যবহৃত শক্তি থেকে আঞ্চলিক খেলোয়াড়ে উন্নীত করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জুলাই সনদে একত্র হওয়া এ লক্ষ্য অর্জনকে আরও বাস্তবসম্মত করেছে। তবে রাজনৈতিক বিভাজন এখনো তীব্র রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা যদি বাংলাদেশের এই নতুন যুগকে গ্রহণ করতে রাজি না হয়, তবে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে পারে।
বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াত—তিন দলেরই নিজস্ব দুর্বলতা আছে, যাতে তারা কেউ এককভাবে ক্ষমতায় গেলে কার্যকরভাবে শাসন করতে হিমশিম খাবে। তাই বর্তমানের ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট নির্বাচনী ব্যবস্থা (যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পায়, সে-ই সরাসরি বিজয়ী হয়) সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব–ব্যবস্থায় (প্রোপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর) পরিবর্তন করা উচিত, যা জুলাই সনদে প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ ও মতাদর্শসম্পন্ন দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে—এ মুহূর্ত কি সম্মিলিত সংস্কারের সূচনা করবে, নাকি নতুন বিভাজনের সূত্রপাত করবে? ফেব্রুয়ারির গণভোট শুধু সংবিধান সংশোধনের ভোট নয়; এটি দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্র ও অঞ্চল নিয়ে আকাঙ্ক্ষার ওপর একটি রায়ও।
প্রশ্নটি স্পষ্ট—বাংলাদেশ কি এই পরিবর্তনের মুহূর্তকে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য ব্যবহার করবে, নাকি আরেকটি সংকটের চক্রে ফিরে যাবে? যদি ঢাকা সফল হয়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দৃষ্টান্তমূলক প্রভাব রাখতে পারবে—অঞ্চলকে বহুত্ববাদ, সংযুক্তি ও সহযোগিতামূলক নিরাপত্তার দিকে এগিয়ে নেওয়ার পথ দেখাতে পারে।
* নাজাম লায়লা, একাডেমি অ্যাসোসিয়েট, ডিজিটাল সোসাইটি প্রোগ্রাম, চ্যাথাম হাউস
![]() |
| কোন দলের কারা কারা জুলাই সনদে সই করল, তা দেখাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৭ অক্টোবর ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং |

No comments