যে যুদ্ধে ইসরায়েল হেরে যাচ্ছে by আতিফা ইকরাম খান
যে টিকটককে এক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল, সেটিকেই এখন তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মরিয়া হয়ে দখল করতে চাইছেন। এটি কেবল অনুমান নয়, হারানো প্রভাব পুনরুদ্ধারের মরিয়া চেষ্টায় ইসরায়েলের প্রচারযন্ত্র এখন সরে যাচ্ছে সেই সব প্ল্যাটফর্মের দিকে, যেগুলোকে তারা একসময় তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করেছিল।
নিউইয়র্কে ইসরায়েলি কনস্যুলেট জেনারেলে মার্কিন প্রভাবশালীদের সঙ্গে এক বৈঠকে নেতানিয়াহুকে বলতে শোনা যায়: ‘আমাদের এমন অস্ত্র দিয়েই লড়তে হবে, যা সেই যুদ্ধক্ষেত্রের উপযোগী, যেখানে আমরা লিপ্ত আছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে। আর বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টিকটক। নাম্বার ওয়ান। নাম্বার ওয়ান।’
তার এই মন্তব্য প্রকাশ করে এক রাষ্ট্রের গভীর হতাশা—যে রাষ্ট্র মরিয়া হয়ে নিজের বয়ানের আধিপত্য ধরে রাখতে চাইছে। ওয়াশিংটন যেটিকে নিরাপত্তা-হুমকি হিসেবে দেখেছিল, তেলআবিব সেটিকেই এখন প্রোপাগান্ডার সুযোগ হিসেবে দেখছে।
মার্কিন সিনেটর মিট রমনি এক সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে বলেছিলেন, কেন যুক্তরাষ্ট্র টিকটকের প্রতি কঠোর হচ্ছে। কারণ, এটি ফিলিস্তিনি কণ্ঠের এক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি টিকটকের পোস্টিং দেখেন এবং অন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের তুলনায় ফিলিস্তিনি ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেখেন, তা বিপুল পরিমাণে বেশি।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই দৃশ্যমানতাই প্ল্যাটফর্মটিকে প্রেসিডেন্টের জন্য বাস্তব আগ্রহের বিষয় করে তুলেছে, যাতে তিনি এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।’
রিপাবলিকানদের মন্তব্যে স্পষ্ট, ‘নিরাপত্তার আড়ালে প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো নিয়ন্ত্রণ। ‘নো লেবেলস’ ওয়েবিনারে প্রতিনিধি মাইক ললার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিক্ষোভই আসলে টিকটক-বিল অন্তর্ভুক্ত করার কারণ। তাঁর মতে, ‘ছাত্ররা প্রভাবিত হচ্ছে... ঘৃণা ছড়াতে... শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে।’
যে কেউ ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডায় অনুপ্রাণিত না হলে সে ‘প্রভাবিত’ হয়েছে—এই অভিযোগ এখন ইসরায়েল ও তার মিত্রদের মুখস্থ বুলি। প্রচলিত মিডিয়া প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে রাখা, লবি ও থিঙ্কট্যাঙ্ক মোতায়েন করা, অনলাইন ভাড়াটে ট্রল বাহিনী চালানো, মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করা, ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রতি পোস্টে ৭,০০০ ডলার পর্যন্ত পরিশোধ করা, গুগলের সঙ্গে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে ফিলিস্তিনপন্থী কনটেন্ট দমন ও ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়া, সাংবাদিক হত্যার বৈধতা প্রচারে ‘লেজিটিমাইজেশন সেল’ নামে সেনা ইউনিট চালানো, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউব-এক্সে অ্যালগরিদমিক দমন—সব মিলিয়েও ইসরায়েলের প্রচারযন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যর্থ হয়েছে ঠিক এই কারণেই যে, সেটি ‘সফল’ হয়েছিল। কারণ, সেটি বাস্তব সময়ে বিশ্বের সামনে নিষ্ঠুরতার রূপ দেখিয়েছে। তারা সফল হয়েছিল ঘরবাড়ি উচ্ছেদে, সাহায্য বন্ধ করতে, বেসামরিকদের অনাহারে ফেলতে, সাংবাদিক ও শিশু হত্যা করতে, হাসপাতাল বোমায় উড়িয়ে দিতে, পাড়া-মহল্লা নিশ্চিহ্ন করতে, একের পর এক যুদ্ধবিরতি উপেক্ষা করতে।
এটি ইতিহাসের প্রথম গণহত্যা যা লাইভস্ট্রিম হয়েছে—ভুক্তভোগীরা নথিবদ্ধ করেছে, কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে আর হত্যাকারীরা তা একই সঙ্গে অস্বীকার করেছে। তবু বিশ্ব যখন নগ্ন চোখে এই নৃশংসতা দেখেছে, তখনও ইসরায়েল সাহস দেখিয়েছে নিজের কাজের সাফাই গাইতে, নিজেকে ভুক্তভোগী দেখাতে আর সব দোষ হামাসের ওপর চাপাতে।
ইসরায়েলের এই মরিয়া চেষ্টা—প্রতিটি মাধ্যমকে নিজের দখলে নেওয়া—প্রকাশ করে আরও গভীর এক সত্য: রাষ্ট্রগুলো, বড় টেক কোম্পানির সঙ্গে মিলে, নাগরিকদের মন নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
ডিজিটাল অবকাঠামো, যা গড়ে উঠেছে কোটি কোটি করদাতার অর্থে, আসলে মানুষের জীবনকে বশে আনা ও মতকে সমরুপ করার হাতিয়ার। প্রযুক্তি নিরপেক্ষ নয়। যিনি সরঞ্জাম বানান, সেটি তার অভিপ্রায়ের প্রতিফলন। পুঁজিপতি ও রাষ্ট্র উভয়ই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত করতে ও অর্থ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ‘ফর ইউ’ পেজ আসলে তোমার জন্য নয়—এটি আনুগত্যের জন্য।
ইসরায়েলের লক্ষ্য পরিষ্কার। তারা যতই ‘বিশ্ব বয়ান হারানো’ নিয়ে আক্ষেপ করুক, হত্যাযজ্ঞ থেকে এক চুলও পিছায় না। যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন ডলারের সহায়তায় ভরপুর হয়ে তারা দাবি করে তাদের হামলা নাকি কেবল হামাসের বিরুদ্ধে। বাস্তবে, তারা ফিলিস্তিনে তৈরি করেছে এক মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যেখানে সাধারণ মানুষ ধ্বংসস্তূপের মাঝে অনাহারে মরছে। তাদের তথাকথিত ‘স্বদেশ-স্বপ্ন’ গঠিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের দুঃস্বপ্নের ওপর। তাদের প্রাচীন স্লোগান ‘এক ভূমি যেখানে মানুষ নেই, সেই ভূমি সেই জাতির জন্য, যার ভূমি নেই’—প্রকাশ করেছিল তাদের গণহত্যার নকশা।
ফিলিস্তিনের জাতিগত নিধন কোনো অতীতের ঘটনা নয়; এটি এক চলমান প্রকল্প। মানচিত্র থেকে জীবন মুছে ফেলতেও তারা (ইসরায়েল) ভয় পায় সেই আয়নাকে, যা সত্যের প্রতিবিম্ব দেখায়—ডিজিটাল জনতার সেই আয়নাকে। তারা চায় শুধু ফিলিস্তিনিদেরই নয়, তাদের কষ্টের সাক্ষীকেও নীরব করতে।
তবু সত্য থামে না। তৃণমূল গণমাধ্যম, নাগরিক সাংবাদিকতা ও বৈশ্বিক ডিজিটাল প্রতিরোধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা সীমিত সম্পদ, বারবার বিদ্যুৎবিচ্ছিন্নতা, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো ও অকল্পনীয় ক্ষতি সত্ত্বেও সত্যের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে আর বিশ্বের বিবেক সেই আলোয় দগ্ধ হয়েছে। তারা তাদের ধ্বংসের মুখে নিজেদের অভিজ্ঞতা বলেছে, অবশিষ্ট যা ছিল তা দিয়ে সব নথিবদ্ধ করেছে, ক্ষমতার পালিশ করা মিথ্যাকে বিশ্লেষণ ও যাচাই করে উন্মোচন করেছে। তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা পাল্টে দিয়েছে বিশ্বজনমতের দৃষ্টিভঙ্গি—ফিলিস্তিন ও হামাস উভয়ের প্রতিই।
ধ্বংসস্তূপ ও মোবাইল ফোন থেকে উঠে আসা এই গল্পগুলো গড়ে তুলেছে নতুন বৈশ্বিক উপলব্ধি, সীমান্তের ওপারে জাগিয়েছে সহানুভূতি ও সংহতি। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, এখন ৫৯ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েলি সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, যেখানে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে এই হার ছিল ৫১ শতাংশ। সাংবাদিক ক্রিস হেজেস লিখেছেন, ‘এই গণহত্যা এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার পূর্বাভাস দিচ্ছে—যেখানে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের প্রক্সি ইসরায়েল পরিত্যক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।’
এই পরিবর্তন স্পষ্ট। রাস্তায় বিক্ষোভ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক বিবৃতিতে—বিশ্ব আর ইসরায়েলের গল্প বিনা প্রশ্নে কিনছে না। এখান থেকে আর ফেরার পথ নেই। ইসরায়েল নতুন প্ল্যাটফর্ম কিনে বা আরেকটি মাধ্যমে মিথ্যা ছড়িয়ে যা-ই করুক, তা ব্যর্থ হবে। মানুষ সত্য দেখে ফেলেছে এবং একবার দেখা সত্য আর অদেখা করা যায় না।
ইসরায়েল সব সময় নিজের অসংখ্য মিথ্যার বহুমাত্রিকতা উদ্যাপন করেছে আর ফিলিস্তিনের একক সত্যকে ঘৃণা করেছে। সত্যের প্রতি তাদের সহনশীলতা শূন্য—তথ্য দিয়ে নয়; বরং সহিংসতা দিয়ে তারা প্রতিক্রিয়া জানায়। প্রতিটি নতুন হামলায়, যা আগের চেয়ে আরও নিষ্ঠুর, তারা প্রমাণ করেছে—তারা সত্যের সঙ্গে সহাবস্থান নয়, সত্যবাহকদের বিনাশ চায়।
কিন্তু মিথ্যা কখনো সত্যকে পরাজিত করতে পারে না। ইসরায়েল নিজেই নিজের প্রচারণাযুদ্ধে নিজের পতন ডেকে এনেছে। যখন জায়নিস্টরা জিজ্ঞেস করে কীভাবে তাদের ভাবমূর্তি উন্নত করা যায়, উত্তর সহজ—শিশু হত্যা বন্ধ করো, জীবন মুছে ফেলা বন্ধ করো, গণহত্যা বন্ধ করো। কৌশলগত গল্প বলার বা অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রণের কোনো যাদু এক রাষ্ট্রকে তার নিজস্ব নৈতিক গহ্বর থেকে উদ্ধার করতে পারে না।
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি কীভাবে ক্ষুদ্র গল্পগুলো বৈশ্বিক চেতনা বদলে দিতে পারে। এখন পরবর্তী ধাপ হলো সচেতনতাকে কর্মে রূপ দেওয়া তা যত ছোটই হোক। ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলতে থাকা। সামর্থ্য অনুযায়ী দান করা। বর্জন করা, এমন ভাষায় লেখা যা দমনকারীর ধার করা নয়। দখলদার যে প্রশ্ন করে, তা না মেনে নিজেই প্রতিরোধে পরিণত হওয়া—সত্যের স্বার্থে।
কারণ ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে—সত্য মিথ্যাকে অস্বীকার করে। কোনো সাম্রাজ্য, কোনো অ্যালগরিদম, কোনো প্রোপাগান্ডা বাজেটই তাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না।
* আতিফা ইকরাম খান, ভারতের একজন স্বাধীন গবেষক। মিডিয়া উপনিবেশবাদ তাঁর গবেষণার আগ্রহের ক্ষেত্র।
- মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মনজুরুল ইসলাম
| বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি |
No comments