চীনের সাবমেরিন পাচ্ছে পাকিস্তান: ভারতের আধিপত্যে চ্যালেঞ্জ

উত্তর ভারত মহাসাগরের কৌশলগত জলসীমায় ভারতীয় নৌবাহিনী নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এই প্রবণতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ভারতের বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তির অধীনে আটটি অত্যাধুনিক হাঙ্গর শ্রেণির ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন পেতে যাচ্ছে। এই নতুন নৌবহর পাকিস্তানের সামুদ্রিক সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেবে। একই সঙ্গে উত্তর ভারত মহাসাগরে ভারতের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হবে। এ খবর দিয়ে অনলাইন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য নির্ধারিত হাঙ্গর শ্রেণির (টাইপ ০৩৯এ ইউয়ান-ক্লাস) সাবমেরিনগুলো এয়ার-ইনডিপেনডেন্ট প্রপালশন (এআইপি) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ। পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের বিপরীতে ডিজেলচালিত সাবমেরিনগুলিকে নিয়মিতভাবে ভেসে উঠে ব্যাটারি রিচার্জ করতে হয়। কিন্তু হাঙ্গরের মতো এআইপি-সজ্জিত সাবমেরিনগুলো ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পানির নিচে টানা অবস্থান করতে পারে। যা তাদের গোপনে চলাচল ও আন্ডারওয়াটার কমব্যাট সক্ষমতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই সাবমেরিনগুলো পাকিস্তান নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হলে ভারতের সামুদ্রিক আধিপত্য সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এই এআইপি-সজ্জিত সাবমেরিনগুলো প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি পারমাণবিক সক্ষম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতেও সক্ষম। আধুনিক ডিজেল-ইলেকট্রিক আক্রমণ সাবমেরিনগুলো ৫৩৩ মিমি টর্পেডো টিউব অথবা উন্নত নকশায় যুক্ত অতিরিক্ত ভার্টিকাল লঞ্চ সেল থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে। হাঙ্গর শ্রেণির সাবমেরিন এই সক্ষমতা পূরণ করে এবং উপযোগী ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত হলে দীর্ঘ পাল্লার হামলাতেও সক্ষম হতে পারে, যদিও এটি সফল ইন্টিগ্রেশনের ওপর নির্ভরশীল।

২০১৭ সালে পাকিস্তান বাবর-৩ নামের পারমাণবিক সক্ষম সাবমেরিন-লঞ্চড ক্রুজ মিসাইল (এসএলসিএম) পরীক্ষা করে। প্রযুক্তিগতভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র হাঙ্গর সাবমেরিনে যুক্ত করা সম্ভব, যা পাকিস্তানের পারমাণবিক ত্রিমাত্রিক সক্ষমতার তৃতীয় ধাপটিও পূরণ করতে পারে। এখনো এটি অনুমান হলেও, হাঙ্গর সাবমেরিন হাতে আসার পর এ সম্ভাবনা আরও জোরালো হয়েছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর এই রূপান্তর আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে বাধ্য। উত্তর ভারত মহাসাগরে ভারতের দীর্ঘদিনের প্রভাব এবার চাপে পড়তে পারে। ভারতীয় নৌবাহিনী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নৌ-আধুনিকায়নের জন্য বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রজেক্ট ৭৫-আই-এর অধীনে দেশীয়ভাবে আরও ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন নির্মাণ- মোট ছয়টি সাবমেরিন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলোতে দেশেই বিকশিত এআইপি প্রযুক্তি যুক্ত করা হবে, যা পানির নিচে দীর্ঘসময় থাকার সক্ষমতা দেবে।

২০১৯ সালে ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিল (ডিএসি) প্রজেক্ট ৭৫ অনুমোদন করে। সেখানে ভারতীয় সরকারি ও বেসরকারি শিপইয়ার্ড বিদেশি সাবমেরিন নির্মাতাদের সঙ্গে যৌথভাবে আধুনিক এআইপি-সজ্জিত সাবমেরিন বানাতে পারবে। তবে প্রকল্পটি নানা জটিলতা, বিদেশি যন্ত্রাংশ নির্মাতার অনীহা ও প্রযুক্তি-হস্তান্তর সমস্যায় ধীরগতির হয়েছে। বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন মাজাগন ডক শিপবিল্ডার্স লিমিটেড (এমএসএল) একমাত্র প্রতিযোগী, যারা জার্মানির থাইসেনক্রুপ মেরিন সিস্টেমসের সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণে আগ্রহী।

যদিও ভারত নিজস্ব এআইপি প্রযুক্তি তৈরি করেছে, কিন্তু আইএনএস খান্দেরি-তে এআইপি বসানোর সময়সূচি নির্ধারিত হয়েছে ২০২৬ সালের জুলাইয়ে। সমুদ্র পরীক্ষা শুরু হতে পারে ২০২৭ সালের মার্চ বা এপ্রিলের আগে নয়, এবং পুরো সমুদ্র ট্রায়াল শেষ হয়ে কার্যকর হতে ২০২৭ সালের জুলাইয়ের আগে সম্ভব নয়। আবারও দেরি হলে সময়সীমা আরও পিছিয়ে যেতে পারে।
বর্তমানে ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে ১৯টি সক্রিয় সাবমেরিন আছে। ১৬টি ডিজেলচালিত এবং ৩টি পারমাণবিক শক্তিচালিত। বেশিরভাগ ডিজেল সাবমেরিনই বার্ধক্যে প্রবেশ করেছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৪টি সাবমেরিন বানানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এখনো মাত্র ছয়টি স্করপিন-ক্লাস সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে। তিনটি পারমাণবিক সাবমেরিন চীনের ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক প্রভাব মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। এর একটি আবার রাশিয়া থেকে লিজ নেয়া। আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্য ধরে রাখতে সাবমেরিন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলো বৃহৎ নৌবহরের বিরুদ্ধে সাশ্রয়ী প্রতিরোধ তৈরি করে এবং কৌশলগত জলসীমায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

ভারতের সামরিক আধুনিকায়ন পরিকল্পনা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। বর্তমানে ৫৪টি নৌযান বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে নৌবহর ২০০ জাহাজ-সাবমেরিনে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে এবং ‘বিল্ডারস নেভি’ হিসেবে নিজেকে রূপান্তর করতে চায় ভারত। কিন্তু ধীরগতির দেশীয় উৎপাদন, আমদানিনির্ভরতা এবং পুরোনো প্ল্যাটফর্মগুলো এসব পরিকল্পনাকে ব্যাহত করছে। পাকিস্তান যখন চীনের হাঙ্গর শ্রেণির সাবমেরিন পাচ্ছে, তখন ভারতের উত্তর ভারত মহাসাগরে নৌ-প্রাধান্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। অতীতেও ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ভারতীয় নৌবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একটি শক্তিশালী পাকিস্তানি নৌবাহিনী ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও বদলে যাওয়া সামুদ্রিক হুমকির কারণে ভারতের এখন এমন সাবমেরিনে জোর দেয়া উচিত, যেগুলো দীর্ঘসময় পানির নিচে থাকতে পারে। সাবমেরিনের পাশাপাশি সি-ড্রোনও ভারতের জন্য কার্যকর বিকল্প হতে পারে। উভয়ই বিমানবাহী রণতরী বা ব্যয়বহুল ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় সস্তা, দ্রুত তৈরি করা যায়। তবে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রতিরক্ষা মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা সবচেয়ে কার্যকর পথ হয়ে উঠতে পারে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.