জনসেবকের ঢল নেমেছে পথে by মহিউদ্দিন আহমদ
একদল হুমকি দিচ্ছে—তাদের কথামতো না চললে তারা দেশটা অচল করে দেবে। আরেক দল হম্বিতম্বি করছে—দেশটা তাদের; সুতরাং তাদের কথাই চূড়ান্ত। এদিকে অন্য একটি দল ঘোঁট পাকাচ্ছে—কিছুই হতে দেবে না। তারা গোলমাল পাকিয়ে সব গুবলেট করে দিতে চাচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে তৈরি হয়েছে একটি অস্থির অবস্থা, একটি যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
আমাদের দেশের বয়স প্রায় ৫৫। প্রথম বছর গেল গোলার আওয়াজ আর বারুদের গন্ধে। তার পর থেকে সময়ের যে রেখাচিত্র দেখছি, তা কখনো সরলরেখায় চলেনি। কিছুদিন শান্তি তো তারপরই শুরু হয়ে যায় অশান্তি। মানুষ স্বস্তিতে ও নিরাপদে থাকতে চান। তাঁদের চাহিদা খুব অল্প; কিন্তু কিছু লোক সেটি কিছুতেই হতে দেবে না।
ফুটবল খেলায় দুই পক্ষে জোর লড়াই হয়। সেখানে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ডিঙিয়ে বল নিয়ে ছুটে যায় গোলমুখে। গোল দিতে দুই পক্ষই মরিয়া। ভালো খেলে বল প্রতিপক্ষের জালে ঢোকাতে না পারলে বা গোল থেকে নিজের জাল বাঁচাতে অনেক সময় প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হয়। ফাউল খেলে। সেটি দেখভাল করার জন্য আছেন রেফারি। কেউ কেউ রেফারিকেও মানে না। উল্টো তর্জনগর্জন করে রেফারিকে ভয় দেখায়। এমনকি তার ওপর হামলা করতেও কসুর করে না। আমাদের রাজনীতির মাঠে এই ফাউল খেলা যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেক সময় মনে হয়, খেলা না হলেই ভালো।
আমাদের দেশে একটি শব্দ বেশ মুখরোচক—গণতন্ত্র। আমরা সবাই এটা চাই। বইয়ে পড়েছি, গণতন্ত্রের জন্ম প্রাচীন গ্রিসে। সেখানে ছিল ছোট ছোট নগররাষ্ট্র। সেসব রাষ্ট্রে ছোট একটি অভিজাত শ্রেণি দরবার বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিত। আধুনিক যুগে এটি আর সম্ভব নয়। এখন দেশে কোটি কোটি মানুষ। তাঁরা একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সেটি অসম্ভব। তাহলে উপায়?
এ থেকেই উদ্ভব হয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেখানে জনপ্রতিনিধিরা মিলে একটি সরকার গঠন করেন। তাঁরা রাষ্ট্র চালান। অনুমান করে নেওয়া হয়, প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে। এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, জন-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ও জনপ্রতিনিধিদের অঙ্গীকার।
ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষার ফারাক আছে। সমাজের সব অংশের চাহিদা একরকম নয়। কিছু আছে পরিপূরক; কিছু আছে সাংঘর্ষিক। এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি সহজ নয়। এ কাজটি করতে হয় জনপ্রতিনিধিদের তথা সরকারকে। সরকারকে ভাবতে হয়—সবার সব চাহিদা পূরণ করা না গেলেও তাঁদের একটি অংশের ক্ষতি করে যেন অন্যরা লাভবান না হয়। এ কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই হয় না। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বা যাঁদের চাওয়ার অনেকটাই পূরণ হয় না, তাঁরা সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তখন মানুষ তাঁদের প্রতিনিধি বদলান। একজনের জায়গায় আরেকজনকে আনেন। প্রতিনিধি মনোনয়ন এবং প্রয়োজনে বদলে ফেলার সবচেয়ে পরীক্ষিত পদ্ধতি হচ্ছে ‘নির্বাচন’। আমরা তাই নির্বাচনে আস্থা রাখতে চাই।
কিন্তু আমাদের আস্থায় চিড় ধরেছে। কারণ, প্রতিনিধিত্বের প্রতিযোগিতায় অনেকেই ফাউল খেলেন। তাঁরা জবরদস্তি করে প্রতিনিধি হতে চান। নির্বাচনব্যবস্থাকে তাঁরা তাঁদের সুবিধা অনুযায়ী সাজান কিংবা তাতে হস্তক্ষেপ করেন। এখানে জনমত নয়, কিছু লোকের ব্যক্তিগত অভিলাষই মুখ্য।
সরকারব্যবস্থাটি এমন যে সেখানে আছে ক্ষমতা। কাজ করতে গেলে তো ক্ষমতা লাগবেই। এখানে কাজের ব্যাপারে দায়িত্ববোধ গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে পড়ে ক্ষমতার চর্চা। এই ক্ষমতালিপ্সার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। একশ্রেণির লোকের লাগামহীন ক্ষমতাচর্চা আমাদের এক অন্ধকার গুহার ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতির ডালা সাজিয়ে মানুষের সামনে হাজির হন। মানুষ খুব ক্ষুধার্ত। একটি সুন্দর জীবনের জন্য যে উপকরণগুলো লাগে, সেটি হাতের নাগালে না থাকায় মানুষ মুখরোচক প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়েন। তাঁরা ভুল লোককে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। একসময় এসে তাঁদের মনে হয়, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। মুশকিল হলো, পরের নির্বাচনে প্রতিনিধি বদল করতে গিয়ে তাঁরা দেখেন—যিনি বিকল্প, তিনিও এর আগে ঠকিয়েছেন। মানুষ যাবে কোথায়?
আমরা এমন একটি ফাঁদে পড়েছি। বের হতে পারছি না। যতই ছোটাছুটি করি, ফাঁদের গেরো ততই শক্ত হয়। প্রশ্ন হলো, এমনটাই কি চলতে থাকবে? কত দিন চলবে?
তাহলে কি ভালো মানুষ নেই? আছে; কিন্তু তাঁদের ‘জনসেবক’ হওয়ার গুণ নেই। সেবক হতে হলে অনেক টাকা লাগে, অনেক ক্ষমতা লাগে। একটি দিয়ে আরেকটি হয়। সাধারণ মানুষ পারতপক্ষে অন্যের কাছে সেবা চাইতে যান না। তাঁরা চান তাঁদের জীবনযাপনের মধ্যে অন্য কেউ যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়; কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ‘জনসেবকেরা’ পণ করেছেন, তাঁরা সেবা দেবেনই। এখানে সাধারণ মানুষের কোনো সম্মতির দরকার নেই।
জনসেবকদের মধ্যে আবার আড়াআড়ি আছে। সবাইকে এক ছাতার তলায় আনা যায় না। তাই আলাদা আলাদা ছাতা, আলাদা আলাদা গোষ্ঠী। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা এগুলোকে বলি রাজনৈতিক দল। জনসেবকদের মধ্যে দলাদলি আছে। তাঁরা সবাই সেবা দিতে চান। নিজেদের মধ্যে হুড়াহুড়ি করেন। দরকার হলে দাঙ্গা বাধিয়ে দেন।
মানুষ কেন এসব দলের ফাঁদে পড়েন? আসলে এসব দলের জনসেবকেরা তো আসমান থেকে টুপ করে পড়েননি! তাঁরা এ দেশের মানুষের মধ্য থেকেই গজিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই তাঁরা জন্মেছেন। যেদিন তাঁরা জনসেবক হওয়ার দীক্ষা নিয়েছেন, সেদিন থেকেই তাঁরা হয়ে উঠেছেন বিশিষ্ট। তাঁদের পেশি ফুলে উঠেছে, কণ্ঠস্বর চড়া হয়েছে, গর্দান পুরু হয়েছে, মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হয়েছে, চামড়া হয়েছে মোটা। পকেট হয়েছে ভারী।
জনসেবক চেনার কয়েকটি সহজ উপায় আছে। তাঁদের পোশাক আলাদা। তাঁরা গায়ে–গতরে একটা কিছু চাপিয়ে নিজেদের ‘ভিনগ্রহের বাসিন্দা’ হিসেবে দেখেন। তাঁরা ভাবেন, দেশের মানুষ অজ্ঞ, বোকা, নিজের ভালো বোঝে না। তাদের সচেতন করতে হবে। জনসেবকেরা বেশি জানেন, বেশি বোঝেন, মানুষকে হেদায়েত করার নৈতিক দায় তাঁদের ওপর বর্তেছে। এটা তাঁরা দায়িত্ব মনে করেন। এই দায়িত্ব মানুষ তাঁদের না দিলে কী হবে, তাঁরা তো তাঁদের দায়িত্বে অবহেলা করতে পারেন না!
জনসেবকেরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান, তাঁর আশপাশে ও পেছনে থাকেন গুচ্ছের লোক। তাঁরা অনেকেই দেখতে বেশ নাদুসনুদুস। অনেক দিন দুধ-ঘি খেয়ে শরীরে জেল্লা এসেছে। তাঁরা মুখে মুখে ছড়া আউড়ে যান, ‘অমুক ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সঙ্গে।’ তো সেই ‘ভাই’ যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন, তিনি অনুগত-অনুসারীদের সম্বোধন করে বলেন—বন্ধুগণ! আসলে তিনি তাঁদের বন্ধু নন, চাকরবাকর মনে করেন। কারণ, তিনি জানেন, ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না।
এখন দিন পাল্টেছে, ভাই-বেরাদররা আর ভাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের দিতে হয় মোটা ভাতা, সঙ্গে নিদেনপক্ষে একটি মোটরবাইক। নেতা যখন হুডখোলা গাড়িতে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলেন, তাঁর আগেপিছে সারি সারি মোটরবাইকে চলে বরকন্দাজের দল। যার মোটরবাইকের বহর যত বড়, তাঁর জোর তত বেশি, নেতৃত্বের সিঁড়িতে তাঁর অবস্থান তত উঁচুতে। সাধারণ মানুষ থেকে উঠে আসা নেতা তখন হয়ে ওঠেন অসাধারণ। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে মোটরসাইকেলের বিক্রি বেড়ে যায়।
শুনতে পাচ্ছি, শিগগিরই নাকি একটি নির্বাচন হবে। সময় আছে ১০ সপ্তাহের মতো। এর মধ্যেই জনসেবকের ঢল নেমেছে পথে।
* মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
- মতামত লেখকের নিজস্ব

No comments