মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হাসিনা

ডনের সম্পাদকীয়ঃ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ একসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। গত বছর গণবিক্ষোভের সময় তার সরকারের কর্তৃত্বমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন এক সম্পাদকীয়তে এসব কথা বলেছে। এতে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের আগস্টে দেশের বাইরে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি রায়ের বিষয়ে বলেছেন, এটি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ এবং ‘প্রস্তুতিপ্রসূত ট্রাইব্যুনালের’ সিদ্ধান্ত। কঠোর রায় দেয়া ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার শাসনামলে এই আদালত তার বেশ কিছু প্রতিপক্ষকে, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশ ও বিএনপি’র নেতা ও কর্মীদের, ১৯৭১ সালের সহিংসতায় জড়িত থাকার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। তখন অনেকেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে অনৈতিক ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করেছিলেন। এখন শেখ হাসিনা নিজেই সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিকার হয়ে গেছেন।

যদিও বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু এ বিষয়ে বিতর্ক কম যে, শেখ হাসিনার শাসন ক্রমবর্ধমানভাবে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। তার আশেপাশের নিকটজনদের সমৃদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিপক্ষদের করা হয়েছে হেনস্থা। গণতান্ত্রিক নীতিমালা উপেক্ষিত হয়ে, শেখ হাসিনা, তার পিতা শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের চারপাশে একটি ব্যক্তিগত রাজনীতি গড়ে তোলেন।

শেখ হাসিনার কঠোর শাসন গত বছরের গণরোষে বিস্ফোরিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত তার সরকারের পতন এবং ভারতের স্বেচ্ছানির্বাসে পাথেয় হয়। স্পষ্ট যে, ২০২৪ সালের অস্থিরতায় তার সরকার প্রতিবাদকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে; নিজে তিনি স্বীকার করেন, ‘আমরা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি।’ এ বছরের শুরুতে তার দলও নিষিদ্ধ হয়, আর তার প্রয়াত পিতা, যিনি একসময় ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে সম্মানিত ছিলেন, আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়ের পরও, দেশটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারেনি। শেখ হাসিনার শাসনের সময় যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে, তা প্রতিবাদ দমন এবং বিরোধী দলের ওপর অব্যাহত আক্রমণে প্রতিহত হয়েছে। আজ বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মুখোমুখি। আগামী বছর নির্বাচন হবে, এবং অস্থায়ী কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন পুনঃস্থাপন করতে হবে। নির্বাচন যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয়, সেজন্য আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়ার বিষয় ভাবতে হবে।

মনে রাখতে হবে, ২০২৪ সালের নির্বাচন, যা বিরোধীরা বয়কট করেছিল, যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল, তা নিরপেক্ষ বিবেচিত হয়নি। এটি তার সরকারের পতনের মূল কারণগুলির একটি। তাই পরবর্তী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া প্রয়োজন, যাতে প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় থাকে।

যারা অপরাধে দায়ী তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। তবে প্রক্রিয়া যদি প্রতিশোধমূলক হয়, বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ডের মতো চরম শাস্তি দিয়ে, তাহলে তা কেবল অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। পরিপক্ব রাষ্ট্রগুলো বিচারের দাবি এবং পুনর্মিলনের প্রয়োজনের মধ্যে সুষম ভারসাম্য রক্ষা করে।

ন্যায্যবিচার ও ক্ষতিপূরণ অপরিহার্য
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টঃ বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘বাংলাদেশে হাসিনার কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ক্ষোভ ও বেদনা রয়েছে। তবে সব আইনগত প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক ন্যায্য বিচারের মানদণ্ড মেনে পরিচালিত হতে হবে। হাসিনার শাসনামলে যারা ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালিয়েছে, তাদেরকে ন্যায্য ও স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে দায়ী করা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসিনার সরকারের অধীনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারদের জন্য স্বচ্ছ, স্বাধীন ও ন্যায্য বিচার ও ক্ষতিপূরণ অপরিহার্য। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আসামিদের অধিকার রক্ষা করা উচিত। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করা।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসের তিন সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ ও দমন কর্মকাণ্ডে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হন। যারা নির্যাতনের জন্য দায়ী তাদের দায়ী করা উচিত। কিন্তু প্রসিকিউশন আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পুরোপুরি আসামিপক্ষের প্রতিনিধিত্ব উপস্থাপনের সুযোগ না দেয়া, সাক্ষীদের জিজ্ঞাসা করার অধিকার এবং নিজের নির্বাচিত আইনজীবী দ্বারা প্রতিনিধিত্বের অধিকার।

মৃত্যুদণ্ডের কারণে বিচার প্রক্রিয়ার ন্যায্যতার উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, জোরপূর্বক নিখোঁজ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনসহ হাসিনার সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও জবাবদিহি অপরিহার্য।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.