ডায়ানার সঙ্গে কি প্রেম করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প?
দিনটি ছিল ১৯৫৩ সালের ২রা জুন। শিশুটির স্কটিশ মা মুগ্ধ হয়ে টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে ছিলেন। সারা দিন তিনি একচুলও নড়েননি। সেই ছেলেটিই ছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
একজন আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে বহু বছর পর ট্রাম্পের লেখা দ্য আর্ট অব দ্য ডিল বইয়ে বৃটিশ রাজপরিবারের প্রতি তার মায়ের ভালোবাসা তার ওপর কতোটা প্রভাব ফেলেছিল, সে কথা লিখেছিলেন।
ট্রাম্পের বৃটেন সফর ইতিহাস তৈরি করবে। কারণ, তিনিই একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি বৃটেনের দু’টি রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন, যার প্রথমটি হয়েছিল ২০১৯ সালে।
আগের সফরে ট্রাম্প উইন্ডসর ক্যাসলে প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন তার মনে নিশ্চয় বারবার তার মা মেরি অ্যান ম্যাকলিওডের ছবি ভেসে উঠেছিল।
ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা সহযোগী ফিওনা হিল তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্প প্রায়ই রাজপরিবারের প্রতি তার মায়ের মুগ্ধতার কথা বলতেন। প্রথম মেয়াদে প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করাটা ছিল ট্রাম্পের একটি চরম আকাক্সক্ষা। কারণ, এটি ছিল তার ‘এই জীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের প্রতীক’।
ট্রাম্প লিখেছিলেন, তার মায়ের কাছ থেকেই তিনি ‘লোকদেখানো কলাকৌশল’ শিখেছিলেন। তিনি তার মাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিনি ‘রাজপরিবারের জাঁকজমক, আভিজাত্য ও চাকচিক্যে মুগ্ধ’ থাকতেন।
যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফরে ট্রাম্প যখন উইন্ডসরে ফিরে এলেন, তখন সেই জাঁকজমক ও আড়ম্বরের প্রতি তার গভীর অনুরাগ এবং লোকদেখানোর প্রবণতা পুরোপুরি প্রকাশ পেতে দেখা গেছে। সেখানে তাকে এতটা উষ্ণ আতিথেয়তা দেয়া হয়েছে, যেন তিনিই রাজা, যেমনটি তিনি নিজেকে ভেবে থাকেন।
এর আগে রাজা চার্লসের পক্ষ থেকে বৃটেন সফরের আমন্ত্রণপত্রটি প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার নিজে ওভাল অফিসে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এটিকে ট্রাম্পের আড়ম্বরপ্রীতির প্রতি সরাসরি আবেদন হিসেবে দেখা হয়। কারণ, বৃটিশ সরকার তখন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছিল।
সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাতের কিছুক্ষণ পরই ট্রাম্প এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক পিয়ার্স মরগানকে বলেছিলেন, ‘আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম আর (ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্পকে) বলছিলাম, ‘তুমি কি কল্পনা করতে পারো, আমার মা এ দৃশ্যটি দেখছেন? উইন্ডসর। উইন্ডসর ক্যাসল।’
ট্রাম্পের কর্মজীবনের শুরুর দিকে যারা তার আশপাশে ছিলেন, তাদের মতে রাজপরিবারের প্রতি তার মুগ্ধতা তখনো স্পষ্ট ছিল।
নগর পরিকল্পনাবিদ ওয়েস ব্ল্যাকম্যান ১৯৯০-এর দশকে ট্রাম্পের সঙ্গে ১০ বছর কাজ করেছিলেন। তিনি তাকে মার-এ-লাগোকে একটি প্রাইভেট ক্লাবে পরিণত করতে সাহায্য করেছিলেন। ব্ল্যাকম্যানের মনে আছে, আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে ট্রাম্প ক্লাবের সম্ভাব্য সদস্য হিসেবে প্রিন্সেস ডায়ানার নাম ব্যবহার করে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন।
তবে সে সময় ট্রাম্পকে একজন বহিরাগত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পাম বিচ ডেইলি নিউজ এমন কিছু অভিজাত ব্যক্তির বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছিল, যারা ট্রাম্পের প্রকল্পে রাজপরিবারের কথিত আগ্রহের বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন।
পত্রিকাটি কাউন্টেস হেলেন প্রাশমা নামের এক নারীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, ‘এটা সদস্য পাওয়ার জন্য ট্রাম্পের একটি কৌশল বলে মনে হচ্ছে।’
অন্যরাও পত্রিকাটিকে বলেছিল, ট্রাম্প হয়তো রাজপরিবারের খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের লাভ তুলে নিতে রাজকীয় দম্পতিকে সম্মানসূচক সদস্যপদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এই বিপণন সম্পর্কে জানে, এমন একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রিন্স চার্লসকে মার-এ-লাগোতে এক বছরের জন্য বিনা মূল্যে সদস্যপদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
উত্তরে চার্লসের পক্ষ থেকে ট্রাম্প একটি চিঠি পান। চিঠিতে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছিল, তিনি চাইলে প্রিন্সের পরিবেশ নিয়ে কাজ করা দাতব্য তহবিলে অনুদান দিতে পারেন। ট্রাম্প সেই চিঠিটিকে একটি ‘দুর্দান্ত চিঠি’ বলে মনে করেছিলেন।
সেই চিঠির কথা ব্ল্যাকম্যানেরও মনে আছে। কীভাবে ট্রাম্প সেই চিঠিতে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, সেটিও তার মনে জ্বলজ্বল করছে। তিনি বলেন, ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সাফল্য এবং ইতিহাসের অংশ হিসেবে পরিচিত হওয়াটা সব সময়ই একটি বড় ব্যাপার ছিল। তিনি এর মধ্যেই বেঁচে থাকতে চান।
১৯৮০’র দশকে ট্রাম্প যখন নিউ ইয়র্ক নগরে নতুন একজন আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন ট্যাবলয়েডগুলোতে খবর বের হয়- প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানা ট্রাম্প টাওয়ারে ৫০ লাখ ডলার মূল্যের একটি কন্ডো কিনতে আগ্রহী। অনেকেই বলেছিলেন, ট্রাম্প নিজেই সম্ভবত এই গুজব ছড়িয়েছিলেন।
পরে বার্তা সংস্থা এপি বাকিংহাম প্যালেসের একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ওই প্রতিবেদনের ‘কোনো সত্যতা নেই’।
প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মুখপাত্র ডিকি আর্বিটার বলেছেন, সে সময়ে রাজপরিবারের ভাবনায় ট্রাম্প একেবারেই ছিলেন না।
ডিকি বলেন, রাজপরিবারের মাধ্যমে প্রচার পেতে মানুষ যুগ যুগ ধরে এমনটা করে আসছে। তারা আপত্তিকর মন্তব্য করবে এবং যতক্ষণ না তা মানহানিকর হচ্ছে, রাজপরিবার এ নিয়ে কিছু করবে না। তাদের মূলমন্ত্র হলো ‘কখনো ব্যাখ্যা দিও না, কখনো অভিযোগ করো না।’
ট্রাম্প নিজেই ‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিল’ বইয়ে এ ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন। অবশ্য সেখানে তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন কিছুটা ভিন্নভাবে। ট্রাম্প লিখেছেন, তিনি একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে একটি ফোনকল পেয়েছিলেন। ওই সাংবাদিক তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, প্রিন্স চার্লস ট্রাম্প টাওয়ারে কোনো অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন কি-না।
ট্রাম্প উল্লেখ করেছেন, সেই সপ্তাহে রাজকীয় দম্পতির বিয়ে হয়েছিল। তারা ছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত দম্পতি’। তিনি এ গুজবটি নিশ্চিত বা অস্বীকার- কোনো কিছুই করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যমের এ খবরটি ট্রাম্প টাওয়ারের প্রচারে সহায়তা করেছিল।
দুই দশকের বেশি সময় পর ট্রাম্প মেলানিয়া নাউসের সঙ্গে তার বিয়েতে প্রিন্স চার্লসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এই বিয়ে মার-এ-লাগোর ২০ হাজার বর্গফুটের একটি নতুন বলরুমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আরেকটি রাজপরিবার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ট্রাম্প মার-এ-লাগোর বলরুম তৈরি করেছিলেন। ট্রাম্প তার নিজের ক্লাবের মডেল হিসেবে ভার্সাইয়ের লুই চতুর্দশের হল অব মিররস’কে বেছে নিয়েছিলেন।
রাজপরিবারের পর্যবেক্ষক হিসেবে পরিচিত ক্রিস্টেন মেইনজার বলেন, ট্রাম্প কয়েক দশক ধরে নিজেকে রাজপরিবারের আদলে গড়ে তোলার এবং নিজের চারপাশে এমন একটি আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন, যেন তিনি অভিজাত শ্রেণির মানুষ।
মেইনজার বলেন, ট্রাম্প যখন মার-এ-লাগো কিনেছিলেন, তখন তিনি মূলত আগের মালিকদের কোট অব আর্মস (বংশীয় প্রতীক) গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেন তিনি অভিজাত, যেন তিনি রাজপরিবারের সদস্য এবং তিনি তার পুরো কর্মজীবনে এটাই করে এসেছেন।’
কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, ট্রাম্পের চোখে বৃটিশ সিংহাসনের বিশ্বব্যাপী মর্যাদা রয়েছে- যা তিনি নিজেও কামনা করেন।
ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক নিয়ে লেখা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিটার হ্যারিস বলেন, বৃটিশ রাজপরিবার হলো সেই উচ্চ সমাজের শিখর, তিনি সব সময় যার অংশ হতে চেয়েছিলেন। তাই তাদের সঙ্গে থাকার অর্থ স্বীকৃতি ও বৈধতা পাওয়া।
কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক হ্যারিস আরও বলেন, এর অন্য দিকটি হলো তিনি কেবল ট্যাবলয়েড মিডিয়ার মনোযোগ চান। এই দু’টি জগৎই একটি পরিবারে বিদ্যমান।
এই অধ্যাপক আরও যোগ করেন, ট্রাম্প সেখানে যেতে পারেন। তিনি জানেন যে, সেখানে তিনি গেলে রাজার সঙ্গে দুর্দান্ত ছবি তোলার এবং করমর্দন করার সুযোগ পাবেন। সেখানে রাজার উপস্থিতিতে কেউ তাকে খারাপ কিছু বলবে না।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় বই ‘দ্য আর্ট অব দ্য কামব্যাক’-এ তিনি লিখেছেন, ‘নারী মহলে তার একমাত্র আফসোস’ ছিল যে তিনি লেডি ডায়ানা স্পেন্সারের সঙ্গে প্রেম করার সুযোগ পাননি। ডায়ানা তার ‘উপস্থিতি দিয়ে ঘর আলোকিত করে দিতেন’ এবং তিনি ছিলেন ‘একজন স্বপ্নের নারী’।
তবে বিবিসি’র সাবেক উপস্থাপক সেলিনা স্কটের মতে, ১৯৯৬ সালে প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে ডেট করার চেষ্টা করেছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি তাকে ‘শ্রেষ্ঠ ট্রফি স্ত্রী’ (যে স্ত্রী স্বামীর মর্যাদার প্রতীক) হিসেবে দেখতেন। স্কট ‘দ্য সানডে টাইমস’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ডায়ানা তাকে বলেছিলেন, ট্রাম্পকে দেখে তার ‘গা শিরশির করতো’। তার অ্যাপার্টমেন্টে ক্রমাগত গোলাপ ও অর্কিড আসতে থাকলে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।
ডায়ানার মৃত্যুর কিছুদিন পর ১৯৯৭ সালে বিতর্কিত রেডিও জকি হাওয়ার্ড স্টার্নের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তিনি চাইলে প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে পারতেন। তবে ২০১৬ সালে তিনি ডায়ানার সঙ্গে কোনো রোমান্টিক সম্পর্কের আগ্রহের কথা অস্বীকার করেন। ট্রাম্প বলেন, তিনি কেবল ডায়ানাকে ‘সুন্দরী’ মনে করতেন।
রাজপরিবারের অন্য নারীদের সম্পর্কেও ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো ছিল আরও বিতর্কিত এবং সমালোচনাপূর্ণ।
২০১২ সালে ফ্রান্সে ছুটিতে সূর্যস্নান করার সময় পাপারাজ্জিদের তোলা বর্তমান প্রিন্সেস অব ওয়েলসের টপলেস ছবির জন্য তিনি তাকে দায়ী করেছিলেন।
এমনকি ট্রাম্প ডাচেস অব সাসেক্স মেগানকে ‘ভয়ানক’ ও ‘বাজে’ বলেছেন। মেগান ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্পকে ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ ও ‘নারীবিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
রানী এলিজাবেথের মুখপাত্র ডিকি আর্বিটারের মতে, এগুলোর কোনোটিই রাষ্ট্রীয় সফরে প্রভাব ফেলবে না। রাজপরিবার সব ধরনের নেতাকে আপ্যায়ন করতে অভ্যস্ত এবং অতীতের কোনো মন্তব্য তাদের বিচলিত করে না।
রাজা চার্লস ঠিকই ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়েছেন। রাজার সঙ্গে ট্রাম্প বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছেন।
আর ট্রাম্পের কথা বলতে গেলে তিনি একসময় তার মাকে রাজপরিবারের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল নারী হিসেবে দেখেছিলেন। ৭০ বছর পর এখন তিনিই তাদের সঙ্গে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

No comments