গাজার হাসপাতালে হত্যাযজ্ঞ ও পশ্চিমা দ্বিচারিতা by মো. সাহাবুল হক

দক্ষিণ গাজার নাসের হাসপাতালে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। হাসপাতালটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন আহত রোগী, নারী, শিশু ও সংবাদকর্মীরা। এ হামলায় ঝরে গেছে অন্তত ২০ জন নিরীহ মানুষের জীবন। নিহত হয়েছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পাঁচজন সাংবাদিক, যাঁরা বিশ্বের কাছে সত্য পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।

হাসপাতাল লক্ষ্য করে গোলা ছোড়া নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের আরেকটি নির্মম উদাহরণ। এর আগেও ইসরায়েলি বাহিনী এই হাসপাতালের ওপর হামলা চালিয়েছে। সাম্প্রতিক এ হামলা আবারও প্রমাণ করল ইসরায়েলের কাছে মানবতার কোনো মূল্য নেই।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইসরায়েলের ইতিহাসে হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী ক্যাম্প, এমনকি জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রও ইসরায়েলের বোমার নিশানা হয়েছে।

১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের সময়ও একই কৌশল নিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। তখনো হাসপাতাল ধ্বংস করা হয়েছিল, সাংবাদিক মারা গিয়েছিলেন। আজও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে গাজায়।

ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এতে ‘খুশি নন’। কথাটি খুবই হালকা ধরনের। এটি যতটা ঠান্ডা, তার প্রতিফলন ততটাই নির্লিপ্ত। এটি কোনো নিন্দা নয়, কোনো প্রতিবাদ নয়, কোনো তিরস্কারও নয়। এটি শুধু একধরনের কূটনৈতিক দায়সারা মন্তব্য। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তাদের কূটনৈতিক, সামরিক ও আর্থিক অভিভাবক। ইসরায়েলের অস্তিত্ব ও আধিপত্যের মূল জ্বালানি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা থেকে। প্রতিবছর প্রায় ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা ইসরায়েল পায়। ফিলিস্তিনের শিশুদের রক্তের বিনিময়ে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, ট্যাংকের চাকা ঘোরে।

২০২৩ সাল থেকে গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ বলছে, গাজার জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি শিশু। তাদের এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। খাবার নেই, পানি নেই, চিকিৎসা নেই। হাসপাতাল ধ্বংস। ত্রাণ ঢুকতে পারছে না। ১৯৪৩ সালে ইউরোপের নাৎসি অবরোধে লেনিনগ্রাদের মানুষ যেমন অনাহারে মারা গিয়েছিলেন, আজকের গাজায় সে দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিবারই মার্কিন ভেটো ইসরায়েলকে রক্ষা করে। অতীতে, যেমন ১৯৮৭, ২০০২, ২০১৪ বা ২০২৩ সালের প্রস্তাবগুলোতে হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র চায় না ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক শাস্তি কার্যকর হোক। চায় না ফিলিস্তিন রাষ্ট্র জাতিসংঘে পূর্ণ স্বীকৃতি পাক। চায় না অপরাধীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হোক। এ দ্বিচারিতা আজকের বিশ্বরাজনীতির সবচেয়ে অমানবিক অধ্যায়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হাসপাতাল ধ্বংসের কৌশল নতুন কিছু নয়। ১৯৯৯ সালে যুগোস্লাভিয়ায় ন্যাটোর বোমা হামলায়ও হাসপাতাল টার্গেট হয়েছিল। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময়ও। কিন্তু পার্থক্য হলো তখন বিশ্ব অন্তত কণ্ঠ তুলেছিল। গাজায় এখন যেন কোনো শব্দ নেই। কেবল শিশুদের আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপের ভেতর চাপা কান্না, সাংবাদিকদের রক্তাক্ত লাশ। নেতানিয়াহু কয়েক সপ্তাহ আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি গাজাকে ‘খালি’ করতে চান। এর মানে হলো জাতিগত নির্মূল। এটি স্পষ্ট গণহত্যা।

জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন বলছে, কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে হত্যা বা ধ্বংসযজ্ঞ গণহত্যা হিসেবে গণ্য হবে। ইসরায়েলের প্রতিটি পদক্ষেপ এ সংজ্ঞার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

এদিকে ট্রাম্প বলেছেন, গাজা যুদ্ধ দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে শেষ হবে। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে মিসর ও কাতার। কিন্তু কাতার ইতিমধ্যে জানিয়েছে, ইসরায়েল কোনো সমঝোতায় রাজি নয়। তাহলে ট্রাম্পের ঘোষণার অর্থ কী? আসলে এটি কেবল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে রাজনৈতিক একটি প্রচেষ্টা। ৯ সেপ্টেম্বর পরিষদ বসছে। সেখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ঘোষণা দিয়েছেন, যদি যুদ্ধবিরতি না হয় এবং ইসরায়েল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি না দেয়, তবে তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। এ কারণেই ট্রাম্প কথাগুলো বলেছিলেন, কিন্তু ফল শূন্য।

ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল আরবদের পরাজিত করেছিল। ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপুর যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অস্ত্র পাঠিয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে লেবাননে, ২০০৮ সালে গাজায়, ২০১৪ সালে গাজায়—প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে।

ইতিহাস বলছে, ইসরায়েল কখনো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রও কখনো ইসরায়েলকে ছাড়বে না।

গাজা আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। ২৫ মাইল দীর্ঘ, ৬ মাইল চওড়া একটি উপকূলীয় ভূখণ্ডে ২৩ লাখ মানুষ বন্দী। সীমান্ত বন্ধ, বন্দর নেই, বিমানবন্দর নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, চিকিৎসা নেই। প্রতিদিন আকাশ থেকে মৃত্যুর বৃষ্টি। শিশুরা জন্ম নিচ্ছে ধ্বংসস্তূপে। মৃত্যুকে দেখছে প্রতিদিন।

এ দৃশ্য ২১ শতকের সভ্যতার জন্য কলঙ্ক। অনেক দেশ ইতিমধ্যেই এককভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স নীরব। তারা এখনো দ্বিধায়। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় তারাই ভূমিকা রেখেছিল।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট, বেলফোর ঘোষণা, জাতিসংঘ বিভাজন পরিকল্পনা—সবকিছুর পেছনে পশ্চিমা শক্তি। আর আজকের এ বিপর্যয়ের মূলেও তাদের দায় অস্বীকার করা যায় না।

গাজার নাসের হাসপাতালে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা কেবল ইসরায়েলি অপরাধ নয়, এটি বিশ্ব বিবেকের ব্যর্থতা। সাংবাদিকেরা সত্য লিখতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। ইতিহাসে সত্যকে হত্যা করা যায়নি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ‘মাই লাই গণহত্যা’র ছবি বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ থেমে গিয়েছিল না হলেও নিন্দা এসেছিল। আজ গাজায় ছবি তুলতে গেলে মৃত্যু, লিখতে গেলে মৃত্যু। তবু সাংবাদিকেরা সত্য দেখাচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন—কী করা উচিত? ১. হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থীশিবিরে হামলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ২. আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে সক্রিয় করতে হবে। ৩. জাতিসংঘকে ভেটো সংস্কার করতে হবে, যাতে একটি মাত্র দেশ ভেটো দিয়ে গণহত্যাকে আড়াল করতে না পারে। ৪. ফিলিস্তিনকে পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ৫. গাজা থেকে অবরোধ তুলে নিতে হবে। ৬. মানবিক করিডর ও আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে গাজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ৮. ব্রিকস, আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো সংগঠনগুলোকে গাজা যুদ্ধ বন্ধে আহ্বান জানাতে এবং কাজ করতে হবে।

বিশ্ব যদি আজ ব্যর্থ হয়, ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে বসনিয়ার স্রেব্রেনিৎসায় ব্যর্থ হয়েছিল। আজ গাজায় যদি ব্যর্থ হয়, এটি হবে ২১ শতকের সবচেয়ে বড় মানবিক লজ্জা।

* ড. মো. সাহাবুল হক, অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-09-01%2Fxfxxi15q%2Fgazahospitalreuters.jpg?rect=0%2C0%2C941%2C627&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif
গাজার নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় আহত একজন চিকিৎসাকর্মী। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.