গাজার ভবিষ্যৎ কেমন হবে?
তাদের এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলি ড্রোন ও যুদ্ধবিমানের গুঞ্জনের মধ্যে জিহান আবু মানদিল দেখছিলেন, তার পাঁচটি ছোট সন্তান দেইর আল-বালাহর এক ক্ষুদ্র, অস্থায়ী তাঁবুর ভেতর খেলছে। গণহত্যার মাঝেও অবরুদ্ধ গাজার আকাশের নিচে সেটি ছিল একটুখানি শৈশবের মুহূর্ত। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ জেনোসাইড স্কলার্স ইসরাইলের এই অভিযানকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, ইসরাইল গাজার প্রায় সবকিছু ধ্বংস করেছে। এর মধ্যে আছে হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, গোটা পাড়া-মহল্লা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ৯০ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ইসরাইল কমপক্ষে ৬৭,১৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ১,৬৯,০০০ জনকে আহত করেছে। আরও হাজার হাজার লাশ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।
গাজার মানুষরা এখনো আশার আঁচ ধরে রেখেছে। গত দুই বছরে বহুবার মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ভেস্তে দিয়েছে ইসরাইল। তবে এবার ট্রাম্প কিছুটা বেশি চাপ প্রয়োগ করেছেন। যদি এই যুদ্ধবিরতি টেকসই হয়ও, গাজার সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজা পুনর্নির্মাণে লাগবে ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সময় লাগবে কমপক্ষে ১৫ বছর সময়, যাতে অঞ্চলটি আবার বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে এই হিসাব কেবল তখনই প্রযোজ্য, যদি ইসরাইলের অবৈধ অবরোধ পুনর্গঠনে বড় বাধা না হয়। আগের ক্ষুদ্র যুদ্ধগুলোর পর বারবার তারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। দোহায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর গাজাবাসী বিশেষজ্ঞ আজমি কেশাওয়ি বলেন, গাজার মানুষ তাদের জীবন ফিরে পেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে প্রস্তুত। কিন্তু শুধু ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট নয়্য। এটা শুধু তাদের ওপর নির্ভর করে না।
গাজার ভবিষ্যতের জন্য পুনর্গঠন যত জরুরি, ততটাই আশঙ্কা রয়েছে, যদি হামাস ক্ষমতা ছাড়ে (যা ট্রাম্পের প্রস্তাবের একটি ধারা), তাহলে অঞ্চলটি বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার মধ্যে ডুবে যেতে পারে। গাজার সাংবাদিক ইয়াসের আল-বান্না ব্যাখ্যা করেন, হামাসের শাসনের একটি সুবিধা হলো তারা নিরাপত্তা বজায় রাখে।
গণহত্যার সময় ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার নিরাপত্তা বাহিনীকে টার্গেট করেছে এবং কিছু কুখ্যাত গ্যাংকে সাহায্য করেছে, যারা সীমিত মানবিক সহায়তা লুট করে কালোবাজারে বিক্রি করছে। তবে কেশাওয়ি মনে করেন, ইসরাইল যদি গাজা ছেড়ে যায়, তাহলে এসব গ্যাং বেশিদিন টিকবে না। সমাজ তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে উপেক্ষা করবে। তবে তিনি সতর্ক করেন, ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে গোষ্ঠীসংঘাত আবারও মাথাচাড়া দিতে পারে। ফাতাহ বর্তমানে পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি নিয়ন্ত্রণ করে। আর হামাস এখনো গাজা শাসন করছে। যদিও ইসরাইলের হামলায় তাদের অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত।
২০০৬ সালে হামাস নির্বাচনে জয়ী হয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব নেয়ার পর দুই দলের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করে। কারণ তারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ ছাড়েনি। যুক্তরাষ্ট্র ফাতাহকে হামাস উৎখাতের জন্য সহায়তা করে। ফলে ২০০৭ সালের জুনে এক সংক্ষিপ্ত গৃহযুদ্ধের পর হামাস ফাতাহকে গাজা থেকে বিতাড়িত করে। এর পর থেকেই ফিলিস্তিন জাতীয় আন্দোলনে গভীর বিভাজন থেকে যায়।
কেশাওয়ি বলেন, যদি ইসরাইল কিছু নির্বাসিত ফাতাহ নেতাকে গাজায় ফিরে আসতে দেয়, তাহলে তারা হামাসের সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারেন। ইসরায়েল যদি এসব মানুষকে ফেরার অনুমতি দেয়, তবে হয়তো হামাসপন্থীদের টার্গেট করবে।
যারা গাজায় রয়ে গেছেন, তাদের সামনে অপেক্ষা করছে মানসিক বিপর্যয়ের এক অনন্ত লড়াই। কেউই এখনো সময় পায়নি নিজের ক্ষতি বুঝে উঠতে। পরিবার, বন্ধু, ঘরবাড়ি, ভবিষ্যৎ সবকিছু হারিয়েছে ইসরাইলের নিরন্তর আক্রমণে। ২০২২ সালে, অর্থাৎ গণহত্যা শুরু হওয়ার আগেই, সেভ দ্য চিলড্রেনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গাজার প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে চারজনই বিষণ্নতা, ভয় ও শোক নিয়ে বেঁচে আছে।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ভয়াবহ সম্মিলিত মানসিক ক্ষত আর দেখা যায়নি। সংস্থার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমদ মাহমুদ আল-সালেম আম্মান (জর্ডান)-এর এক ক্লিনিকে গাজার শিশুদের চিকিৎসা করতেন। তিনি দেখেছেন অধিকাংশ শিশু ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন, বিষণ্নতা ও অনিদ্রায় ভুগছে। লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক ডেরেক সামারফিল্ড আল জাজিরাকে বলেন, গাজার শিশুরা এখন যা পার করছে, তা কল্পনারও অতীত। কমপক্ষে ১৭,০০০ শিশু এখন একা। তাদের কোনো অভিভাবক নেই। তারা আদৌ কখনো নিরাপদ জীবনে ফিরতে পারবে কিনা, তা অনিশ্চিত। তিনি আরও বলেন, এই শিশুদের ভবিষ্যৎ তাদের মানসিক ট্রমা কাটিয়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে না। কারণ ট্রমা তো এখনো শেষ হয়নি। তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তাদের সমাজের ওপর। আর সেই সমাজই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণেই এটাকে আমরা গণহত্যা বলি।
আবু মানদিলের এখন একটাই আশা, সন্তানদের জন্য অন্তত সামান্য একটি ভবিষ্যৎ তৈরি করা। তার স্কুলপড়ুয়া সন্তানরা টানা দুই বছর ধরে কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাচ্ছে না। কিন্তু একসময়ের ভূগোল শিক্ষিকা হিসেবে তিনি নিজেই তাদের অল্পবিস্তর পড়াচ্ছেন, যেন খুব বেশি পিছিয়ে না পড়ে তারা। তিনি বলেন, আমি শুধু চাই, তাদের ভবিষ্যৎ আমাদের চেয়ে ভালো হোক। অবিরাম হত্যাযজ্ঞে আমি সন্তানদের নিয়ে ভীষণ ভয়ে আছি। সত্যি বলতে, আমি শুধু চাই, একদিন ওদের গাজা থেকে বের করে আনতে পারি।
![]() |
| ‘সমস্ত গাজা উপত্যকা আনন্দে ভাসছে’ শান্তি চুক্তির ঘোষণা শোনার পর দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে বাসিন্দারা উল্লাসে ফেটে পড়েছেন। তারা রাস্তায় নেমে উল্লাস করছেন। দলবদ্ধভাবে নাচছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর দিয়েছে। তাদের একজন ওয়ায়েল রাদওয়ান। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে, যুদ্ধ থেমে গেছে। আমরা খুবই খুশি যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এটি আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় এবং আমরা ধন্যবাদ জানাই আমাদের সেই ভাইদের ও সকলকে, যারা যেভাবেই হোক যুদ্ধ থামাতে এবং রক্তপাত বন্ধ করতে অবদান রেখেছেন। আরেক বাসিন্দা আবদুল মজিদ রব্বো বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, যুদ্ধবিরতি হয়েছে, রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটেছে। শুধু আমি নই, পুরো গাজা উপত্যকা খুশি। সব আরব জনগণ খুশি। সারা পৃথিবী খুশি এই যুদ্ধবিরতি ও রক্তপাতের সমাপ্তিতে। ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা জানাই তাদের সবাইকে যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। |

No comments