যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র দিলে ‘গণতন্ত্র’, ইরান ড্রোন দিলে কেন তা ‘সন্ত্রাস’? by গ্রেগরি শুপাক

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের ড্রোন ব্যবহার করায় যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো খুব খেপেছে। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানগুলোই নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রপ্তানিকে মহৎ কাজ হিসেবে দেখিয়ে যাচ্ছে।

ফোর্বস ম্যাগাজিনে সাংবাদিক পল ইডোন ইরানকে ‘রাশিয়ার আগ্রাসী লালসার সহচর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফরেন পলিসি সাময়িকীতে এলি জেরানমায়ে ও সিনজিয়া বিয়ানকো লিখেছেন, ‘ইউক্রেনে ইরানের অস্ত্র যাওয়া ঠেকানো এবং ইরানের অভ্যন্তরের নাগরিকদের দৈনন্দিন খরচ বৃদ্ধি কীভাবে করা যায়, তার উপায় আমেরিকা ও ইউরোপের খুঁজে বের করা উচিত।’

ওই একই সাময়িকীতে জন হার্ডি ও বেনহাম বেন ট্যালেবলু লিখেছেন, ইরানের শাহেদ-১৩৬ ড্রোন ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘সন্ত্রাসের বিস্তারে’ সহায়তা করছে এবং এ ধরনের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি ‘পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ইরানের আক্রমণের শামিল’। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের সম্পাদকীয়তে বলেছে, এই ড্রোন রপ্তানি করে ইরান ‘সমস্যা সৃষ্টি করছে’ এবং ‘রাশিয়ার ইউক্রেন ধ্বংসে সহায়তা’ করছে।

অন্যদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো গত সপ্তাহেও আমেরিকার অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। সাংবাদিক পিটার বারজেন সিএনএন টেলিভিশনে সম্প্রতি বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে এবং ইউক্রেনকে হিমার্স মিসাইল ও এমওয়ান ট্যাংকসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করে ‘সত্যিকারের নেতৃত্বের’ পরিচয় দিয়েছেন।

এ ছাড়া জেফরি স্যাক্স বলেছেন, গত মার্চে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে যাচ্ছিল এবং এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার দখলকৃত ভূখণ্ড হাতছাড়া করতে রাজি হয়েই কিয়েভ যুদ্ধ সমাপ্তির দিকে যাচ্ছিল; কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সেই শান্তি উদ্যোগে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছেন এবং ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিল থেকে উঠে যেতে সহায়তা করেছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ব্রেট স্টিফেন লিখেছেন, ‘এফ-১৬ জঙ্গি বিমানসহ সব ধরনের সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর এটিই মোক্ষম সময়।’

তবে এর মধ্যে দ্য বুলেটিন অব দ্য অ্যাটোমিক সায়েন্সেস-এর অবস্থান উল্টো। তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার দ্বার খোলা রাখা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো জোট ও অন্যান্য মিত্ররা যদি সামরিক সংঘাতকেই সমাধানের একমাত্র রাস্তা হিসেবে বেছে নেয়, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।

ওয়ার রিজার্ভ স্টক পাইল অ্যামিউনিশন-ইসরায়েল (ডব্লিউআরএসএ-১) নামে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের যে অস্ত্রের মজুতখানা আছে, তা তাদের ভাষায় গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নিবেদিত। মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ধরনের যুদ্ধ লাগলে যাতে দ্রুত এই অস্ত্রগুদাম থেকে অস্ত্র নিয়ে ব্যবহার করা যায়, সে জন্য এই মজুত গড়ে তোলা হয়েছে। মিখাইল মাকোভস্কি ও ব্লেইজ মিজতাল লিখেছেন, ইসরায়েলের গুদাম থেকে অস্ত্র নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে।

মিখাইল মাকোভস্কি ও ব্লেইজ মিজতাল মনে করেন, এই যুদ্ধ মূলত রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি যুদ্ধ। তাঁরা মনে করেন, পশ্চিমারা শুধু ইউক্রেনে গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এই যুদ্ধে জড়ায়নি; বরং রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর বিদ্যমান রশি–টানাটানির ধারাবাহিকতা হিসেবেও তারা এই লড়াইয়ে নেমেছে।

এ ছাড়া ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় মিখাইল মাকোভস্কি ও ব্লেইজ মিজতাল একটি উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন, ‘বাইডেন প্রশাসন যখন ইউক্রেনে কামানের গোলা পাঠিয়েছে, ঠিক তখন ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রগুদাম “গণতন্ত্রের ডিপো” হিসেবে কাজ করছে।’

তবে সবাই বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অস্ত্র ব্যবহারকে ‘গণতন্ত্র’ বলে চালানো কতটা অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। কারণ, ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবহার গোটা অঞ্চলে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।

কিন্তু মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো একদেশদর্শীভাবে ইরানের ড্রোন সরবরাহকে ‘সন্ত্রাসী কাজে সহায়তা’ হিসেবে দেখাচ্ছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহারকে গণতন্ত্রচর্চা বলে ন্যায্যতা দিচ্ছে।

পশ্চিমা গণমাধ্যমের এই দ্বিমুখী নীতি নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

* গ্রেগরি শুপাক, টরন্টোর গুয়েলফ-হাম্বার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিষয়ের শিক্ষক। তাঁর দ্য রং স্টোরি: প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল অ্যান্ড মিডিয়া শিরোনামের একটি বই রয়েছে

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ইরানের ড্রোন ব্যবহার করছে
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ইরানের ড্রোন ব্যবহার করছে। ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.