সিরিয়ায় ‘ব্যর্থ’ আল-শারা, নির্বাচন কি শাপে বর হবে by জাসিম আল-আজ্জাওয়ি

আগস্টের শুরুর দিকে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) কুর্দি-অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার মানবিজের কাছে সিরিয়ান সরকারি বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি চালায়। উত্তরের এই উত্তেজনা এসেছিল দক্ষিণের সুয়াইদা অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কয়েক সপ্তাহ পর, যেখানে ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন এবং প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। দ্রুজ ও সুন্নি বেদুইন গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সহিংসতা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলেছে এবং এখনো পুরোপুরি থামেনি।

মার্চ মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত গোষ্ঠীগুলো লাতাকিয়া ও টারতুস উপকূলীয় অঞ্চলে সরকারি বাহিনী এবং মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ জন নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক; ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ জন বাস্তুচ্যুত হয়।

বারবার সংঘটিত এই সহিংসতা প্রকাশ করে দিচ্ছে সেই খোলামেলা সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে, যেটিকে একসময় আসাদ ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এখন তাঁর অনুপস্থিতিতে, সেই বিভাজনগুলো আরও বিস্তৃত হচ্ছে—দশকের পর দশক ধরে চলা অনিষ্পন্ন ক্ষোভ, জমি নিয়ে বিরোধ এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিস্তারের কারণে।

আসাদকে অপসারণের পর ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারা এখনো সব গোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, তাঁর প্রধান মনোযোগ ছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে। তাঁর ইসলামপন্থী ঝোঁক সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। দ্রুজ, আলাউই, খ্রিষ্টান ও কুর্দিরা আশঙ্কা করছে যে তিনি বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে আরও সহিংসতা ঘটতে পারে।

আগামী সেপ্টেম্বরের নির্বাচন শারা সরকারের জন্য আনুষ্ঠানিক বৈধতা বয়ে আনতে পারে। তবে প্রকৃত নিরাপত্তা ও পুনর্মিলন ছাড়া এই নির্বাচন বিদ্যমান বিভাজনকে আরও গভীর করার ঝুঁকি তৈরি করছে এবং এমন একটি ক্ষমতার কাঠামোকে শক্তিশালী করছে, যা প্রকৃতপক্ষে ঐক্যবদ্ধ জাতির বদলে কেবল কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করবে।

পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট আল-শারা তাঁর জাতীয় কৌশলে মূলত পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখানেই প্রধানত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে।

মে মাসে আলেপ্পো শহরে (সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর) এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে আল-শারা সিরিয়ানদের পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হয়েছে আর এখন আমাদের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে।’

দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে আল-শারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উপসাগরীয় দেশগুলোর সহায়তায় তিনি একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন: যুক্তরাষ্ট্র সরকার আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়েছে এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’-এর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এসডিএফকে নতুন নিরাপত্তাকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনাকেও সমর্থন জানায়।

ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে, দামেস্কের নতুন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া ইরানের প্রভাব কমাতে এবং সিরিয়াকে হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের করিডর হওয়া থেকে বিরত রাখতে সহায়ক হবে।

অন্যদিকে আল-শারার কাছে এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈধতা সুনিশ্চিত করার একটি সুযোগ।

সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্কও আল-শারার জাতীয় কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। দেশটি যুদ্ধ ছাড়া সামরিক সহায়তা, যেমন প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে সিরিয়ার নিরাপত্তা অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য। পাশাপাশি তারা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা রাখার পরিকল্পনা করছে। এ মাসে তুরস্ক সিরিয়ায় প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছে, যা উত্তরের জ্বালানি–সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করছে।

এদিকে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোও সিরিয়ার অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জুলাইয়ে সৌদি আরব ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের রিয়েল এস্টেট ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ ঘোষণা করে।

এর দুই সপ্তাহ পর সিরিয়ান সরকার কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে গণপরিবহন ও রিয়েল এস্টেট খাতে ১৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে।

তবে অনেক সমালোচক যুক্তি দেন, অর্থনৈতিক সহায়তা একটি দেশের পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য হলেও, এককভাবে এটি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে না। ঝুঁকি রয়েছে যে টাকা ও উন্নয়ন প্রকৃত ক্ষোভ ও বিভাজনগুলোকে ঢেকে রাখবে, যা ভবিষ্যতে আবারও সংঘাত উসকে দিতে পারে।

নতুন সিরিয়ান সরকারের জন্য প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জরুরি প্রয়োজনের সঙ্গে জনগণের অভিযোগ-অভিমত ও ক্ষোভ নিরসনের সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করা।

আইনসভার নির্বাচন

অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা নিরসনের একটি উপায় হলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জন আস্থা অর্জন করা। আল-শারা সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচনের ডাক দিয়েছেন। তবে সাধারণ সিরিয়ানরা সেখানে ভোট দিতে পারবেন না। কারণ, ২১০ আসনের মধ্যে ১৪০টি আসন বেছে নেবে স্থানীয় নির্বাচনী কমিটি এবং বাকি ৭০টি আসন সরাসরি প্রেসিডেন্ট নিজে মনোনীত করবেন। কোনো আসনই সরাসরি জনগণের ভোটে পূরণ হবে না।

এই কাঠামো মূলত একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক হিসাব। এটি নতুন নেতৃত্বকে নিয়ন্ত্রিত ফলাফলের নিশ্চয়তা দেয় এবং একই সঙ্গে সার্বিক জাতীয় ভোট আয়োজনের জটিলতা এড়ায়; বিশেষত তখন, যখন দামেস্ক এখনো দেশের সব ভূখণ্ডের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই এবং নিরাপত্তাও নিশ্চিত নয়।

তবে এই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে অনেক সিরিয়ানই অবিশ্বাসের চোখে দেখবেন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো। তাদের কাছে এটি সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষে পক্ষপাতমূলক বলে মনে হবে।

কেউ কেউ হয়তো নির্বাচন বর্জনের পথ বেছে নেবেন, একে অবৈধ ঘোষণা করবেন কিংবা ভিন্ন উপায়ে তাঁদের গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করবেন। কারণ, এই ব্যবস্থায় তাঁদের অর্থবহ কণ্ঠস্বর থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিবিড়ভাবে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে এবং এটি যদি সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, তবে তারা সমালোচনামূলক অবস্থান নেবে।

এর ফলে নতুন সরকারের নবগঠিত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে এবং পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও সমর্থন পাওয়ার প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

দামেস্কের জন্য আরও জরুরি সমস্যা হলো—এই নির্বাচন দেশটির গভীর ক্ষত সারাতে কোনো ভূমিকা রাখবে না, বিশেষত চলমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে। তাই সিরিয়ার এখন সবচেয়ে প্রয়োজন একটি সর্বজনীন জাতীয় পুনর্মিলন প্রক্রিয়া।

ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি

সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার এখনো ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির জন্য কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা উপস্থাপন করতে পারেনি। বাশার আল-আসাদের আমলে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, যার মধ্যে ছিল গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন ও রাসায়নিক হামলা—এগুলো আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞের জন্য দোষীদের জবাবদিহির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

জবাবদিহির অনুপস্থিতি কেবল নৈতিক ব্যর্থতা নয়, কৌশলগত ব্যর্থতাও বটে। অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনার মতো আইনগত কাঠামো না থাকলে সিরিয়ার ক্ষত আরও গভীর হবে।

সিরিয়ার প্রয়োজন একটি নতুন সামাজিক চুক্তি। জনগণ আর সেই পুরোনো দায়মুক্তির ভিত্তি মেনে নেবে না, যা অতীত শাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল।

ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির প্রক্রিয়াটি অবশ্যই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হতে হবে। বাশার আল-আসাদের দীর্ঘকালীন এক পরিবারকেন্দ্রিক শাসন, যা আলাওয়ি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এর প্রেক্ষাপটে নতুন সরকার এককভাবে বিচারক হতে পারে না।

রাষ্ট্র–নেতৃত্বাধীন কোনো প্রক্রিয়াকে সহজেই নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায় বা পুরোনো শাসনের অনুগতদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে দেখা হতে পারে। এই ধারণা দূর করতে এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে জাতিসংঘের, সহায়তা সিরিয়ার জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর মতো একটি কাঠামো শক্তিশালী কৌশল হতে পারে। এটি শুধু শাস্তির দিকে মনোযোগ না দিয়ে অতীতের অপরাধ—যেমন গণহত্যা, নির্যাতন ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনাগুলো উন্মোচনের ওপর অগ্রাধিকার দেবে।

এ প্রক্রিয়া সিরিয়াকে শাস্তিমূলক বিচারব্যবস্থা থেকে দূরে সরাতে সাহায্য করতে পারে, যা সমাধান না দিয়ে কেবল শুদ্ধীকরণে মনোযোগ দেয়। এটি নতুন শাসনব্যবস্থার প্রতি জনআস্থা তৈরি করতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বয়ান নয় বরং একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে নতুন সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করতে পারে।

একই সঙ্গে এটি ফেডারেলিজমের দাবিকে প্রশমিত করতে পারে, যা দেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দুর্বল করার ঝুঁকি তৈরি করছে।

সিরিয়ার রূপান্তর কখনোই সহজ হতো না। কিন্তু বর্তমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও সামরিকীকৃত রাজনীতির সিরিয়াকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আনুষ্ঠানিক অগ্রগতিকে অভিনন্দন জানানোর বাইরে যেতে হবে। তাদের অবশ্যই নাগরিক সমাজকে সহায়তা করতে হবে এবং অতীত ও বর্তমান অপরাধের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি তুলতে হবে।

অন্যথায় সিরিয়ার ভবিষ্যৎ ভয়ংকরভাবে অতীতের মতোই হয়ে উঠবে—নতুন নেতৃত্ব থাকবে। কিন্তু সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার পুরোনো চক্র একই রকম অব্যাহত থাকবে।

* জাসিম আল-আজ্জাওয়ি, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম প্রশিক্ষক
- আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মনজুরুল ইসলাম

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2024-12-26%2Fk23178qy%2F2024-12-26T105841Z588710960RC2WWBAN2RSORTRMADP3SYRIA-SECURITY.JPG?w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif
দামেস্কের সড়কে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর দুই সদস্য। সিরিয়া, ২৬ ডিসেম্বর। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.