মৌলভীবাজারের যে বাড়ি পাখিদের ‘আপন ঠিকানা’ by আকমল হোসেন
মৌলভীবাজারের মোকামবাজার-অফিসের বাজার সড়ক ধরে যাওয়ার পথে তখন এ রকমই সকালের পরিবেশ। একঝলকে খানিকটা দূরে ধানখেতের এক প্রান্তে চোখে পড়ে, একটি বাড়ির গাছে গাছে যেন সাদা কাঠগোলাপের মতো থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। হাওয়ায় সেই ফুলের পাপড়ি দুলছে।
এরপরই কাছে যাওয়া, এসব ফুলের সঙ্গে পরিচয়। তবে ওই বাড়ির গাছে গাছে সাদা কোনো ফুল ফোটেনি, ফুল হয়ে ফুটে আছে সাদা বক। এখানে বক পাখি সংসার পেতেছে। সঙ্গে আছে কালো পানকৌড়ির দল, শালিকসহ নানা রকমের পাখিও।
সকালবেলা মাত্র ঘুম থেকে উঠছেন বাড়ির লোকজন। পাখিরা সমবেত ডাকে সরগরম করে রেখেছে সারা বাড়ি। বাড়ির লোকজন অনেকটা বছর ধরে এসব পাখির সঙ্গে আছেন, পাখিরা তাঁদের সঙ্গে আছে। ওই ডাককে তাঁরা আর আলাদা করতে পারেন না। পাখি, পাখির ডাক—সবকিছুই এখন তাঁদের বাড়ির অংশ হয়ে গেছে, সংসারযাপনের অংশ হয়ে গেছে।
এটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আজমেরু গ্রামের একটি বাড়ি। বাড়ির তিন দিকেই ফসলের খোলা মাঠ। পূর্ব দিকে মাঠ শেষে আছে খাইঞ্জার হাওর।
বাড়ির কর্তা মো. এরশাদ মিয়া বলেন, ‘অনেক বছর ধরি পাখিরে রাখছি। পাখিরে পাহারা দিই। রাইতে ডাক শুনলে জানের দিকে চাই না, ঘর থাকি বাইর অই যাই। অনেকে শিকার করতো চায়। দিনের বেলায়ও কেউ কেউ আয়। কেউরে পাখি মারতে দিই না। আরও তো বাগান আছে। তারা যায় না। এখানে আশ্রয় পাইছে বলে আইছে। তারারে যত্ন করি রাখি।’
সম্প্রতি সকালে দূর থেকে যে রকমটা দেখা গেছে, গাছে গাছে সাদা সাদা ফুল হয়ে আছে পাখি। কাছে গেলে তার পরিমাণ যেন আরও বেড়ে যায়। এরশাদ মিয়ার বাড়ির পশ্চিম দিকের একটি পুকুরের পাড় ঘেঁষে আম, তেঁতুল, সুপারিসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ আছে। প্রায় সব কটি গাছেই বসে আছে ছোট-বড় অসংখ্য বক।
কাছেপিঠে আছে পানকৌড়ি। সাদার ফাঁকে ফাঁকে সবুজের সঙ্গে মিশে থাকা কালো রঙের পাখি। পানকৌড়ি নড়লে-চড়লেই ভালো করে চোখে পড়ে। মানুষ, বক ও পানকৌড়ি ওই বাড়িতে ‘মিলেমিশে আত্মীয় যেন’।
প্রায় গাছেই আছে পাখির বাসা। কোনোটিতে এখনো পাখির ছানা বসে আছে। কাছেই মা-বাবার মধ্যে কোনো না কোনোটি পাহারায়। দূর থেকে মা অথবা বাবা আধার নিয়ে আসছে, ছানার হাঁ করা মুখের ভেতর খাবার ঠেলে দিচ্ছে। সন্তান বাৎসল্যে ভরপুর বাড়ির সব কটি গাছ। বাড়ির পশ্চিম দিকটাতে চলার উপায় নেই। পাখির বিষ্ঠায় সাদা সাদা হয়ে আছে গাছতলা।
ওই গ্রামেরই মাদ্রাসাছাত্র মো. তারেক জানিয়েছে, সে প্রায়ই পাখি দেখতে ওই বাড়িতে যায়। বাড়ির লোকজন যেমন, প্রতিবেশীরাও তেমন পাখির প্রতি নজর রাখেন। প্রতিবেশীরা মনে করেন, এই পাখি তাঁদের সবার। কেউ পাখিকে বিরক্ত করেন না।
বাড়ির লোকজন ও স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ওই বাড়িতে পাখি আশ্রয় নিয়েছে। কমবেশি সারা বছরই বাড়িতে পাখি থাকে। তবে কার্তিক মাসে পাখির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। তখন অসংখ্য পাখিতে সব কটি গাছ সাদা হয়ে ওঠে। ভোরের দিকে পাখিরা জেগে যায়, তারপর ডাকতে শুরু করে। ডাকতে ডাকতে বাসা ছেড়ে মাঠের দিকে, কিংবা হাওরের দিকে উড়াল দেয়। সারা দিন বাইরে থাকে। বিকেল হলে আবার বাড়িতে ফিরতে শুরু করে।
| ঝাঁক বেঁধে পাখি নীড়ে ফিরছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আজমেরু গ্রামের একটি বাড়িতে। ছবি: প্রথম আলো |
No comments