ইউরোপের কঠোর নিয়ম যেভাবে পরিবারগুলোকে আলাদা করে দিচ্ছে

গার্ডিয়ানের রিপোর্টঃ জুন মাসে জার্মান সংসদের সামনে দাঁড়িয়ে আহমেদ শেখ আলি অশ্রু সংবরণ করছিলেন। হাতে তুলে ধরেন তার তিন বছরের ছেলের অস্পষ্ট একটি ছবি। দুই বছরেরও বেশি আগে আলেপ্পো থেকে পালিয়ে আসার পর থেকে তিনি সবকিছু করেছিলেন ছেলের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য। হ্যানোভার শহরে বসবাস শুরু করেন। পূর্ণকালীন চাকরি পান। আর পরিবারকে কাছে আনার জন্য কাগজপত্রের অসংখ্য ঝামেলা পেরিয়ে আসেন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। তিনি প্রায় পরিবারের সাথে পুনর্মিলনের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। তার আবেদনটির আগে মাত্র দুটি মামলা বাকি ছিল। কিন্তু হঠাৎই জার্মান সংসদের নিম্নকক্ষ জুনে একটি বিল পাস করে।

তাতে বলা হয় তার মতো অভিবাসীদের জন্য পারিবারিক পুনর্মিলন প্রক্রিয়া অন্তত দুই বছরের জন্য স্থগিত থাকবে। কান্নাভেজা কণ্ঠে আহমেদ জানান, এই সিদ্ধান্ত জানার পর থেকে আমি ঘুমাতে পারি না। জীবন চালিয়ে নিতে পারি না। যখন আমি ছেলেকে রেখে আসি, সে হামাগুঁড়ি দিত। সে এখন হাঁটছে। অনলাইন গার্ডিয়ানে তার এই দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একই অবস্থা আরও অনেকের। রিপোর্টে বলা হয়, এটি কেবল এক ব্যক্তির কষ্ট নয়। কয়েক মাসে ইউরোপের একাধিক সরকার এমন পরিবারের পুনর্মিলনের সুযোগ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মানবাধিকারকর্মীদের মতে, রাজনীতিবিদরা নিজেদের ‘অভিবাসন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণকারী’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। সেভ দ্য চিলড্রেন ইউরোপের ফেদেরিকা তোসকানো বলেন, এটি আসলে কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। রাজনীতিবিদরা একদিকে বলছেন অভিবাসনকে সুশৃঙ্খল, ন্যায্য আর পরিকল্পিত করতে চান। আর পরিবারগুলোর পুনর্মিলনই তো সবচেয়ে সুরক্ষিত, আইনসম্মত আর সমাজে একীভূত হওয়ার অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি।
মার্চে অস্ট্রিয়া প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে শরণার্থীদের জন্য পরিবারিক পুনর্মিলন সাময়িকভাবে স্থগিত করে। অজুহাত দেয় সমাজসেবার ওপর বাড়তি চাপের কথা। পরে জার্মানি, পর্তুগাল, ফিনল্যান্ড এবং বেলজিয়ামও একই পথে হাঁটে। বেশ কয়েকটি সরকার জরুরি পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। অথচ এসব পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশন ও ইইউ চার্টারে স্বীকৃত ‘পারিবারিক জীবনের অধিকার’-এর সঙ্গে।

তোসকানোর ভাষায়, পারিবারিক ঐক্য আমাদের সমাজে এক মহান মূল্যবোধ। কিন্তু বিদেশিদের পরিবার হলে সেটি যেন কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। সেভ দ্য চিলড্রেন ফিনল্যান্ডের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পারিবারিক পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া গড়ে সাড়ে ছয় বছর সময় নেয়। কেউ কেউ এমনকি ১০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকেছেন। এদিকে পারিবারিক পুনর্মিলনের মাধ্যমে আসা মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রিয়ায় ২০২৩ ও ২০২৪ সালে পারিবারিক পুনর্মিলন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ১৮০০০ মানুষ গিয়েছে। এর মধ্যে ১৩০০০ই শিশু। তারা অনেকেই বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দীর্ঘ, বেদনাদায়ক সময় পার করেছে। তোসকানোর মতে, যত বেশি সময় এই প্রক্রিয়া নেয়, তত বেশি মানসিক আঘাত সঞ্চিত হয় শিশুদের মনে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.