মৃত্যুর পর ‘নিরাপদে শেষ ঘুমের’ গ্যারান্টি চাই by কাজল ঘোষ
‘মব’কে প্রেসার গ্রুপ বলে বলে ‘মবের’ যে ব্যাপক বিস্তার তা রোধ না করে সরকার একেকটি ঘটনার পর নিন্দা জানাচ্ছে। আর কার্যত তা সীমাবব্ধ থাকছে বিবৃতির মধ্যেই। দায়সারা এই বিবৃতি নিয়ে মানুষ এখন হাসছে। অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা লাখো ফিডে ভেসে বেড়াচ্ছে।
৫ই আগস্ট চব্বিশের পর মবোক্রেসিতে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় দুইশো ছুঁই ছুঁই। আর মাজার-সমাধি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে অন্তত অর্ধ-শতাধিক। এসব ঘটনায় সরকারি হিসাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ২০ জনের মতো। অথচ মব তাণ্ডবে যুক্ত হয় শত শত মানুষ, আর গ্রেপ্তার হয় গুটিকয়েক। তাও আবার লোক দেখানো।
ধরুন, শুক্রবার রাতের কথা। শাহবাগে একটি সমাবেশ হয়েছে। সন্ধ্যায় সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে। এই খবরটি যখন নিউজরুমে আসে তখন ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়- আবার কী হলো? অল্প পরেই খবর আসে রাজবাড়ী থেকে, তৌহিদী জনতা কবর থেকে লাশ তুলে উল্লাস করছে, লাশ পুড়িয়ে তাদের বর্বরতাকে দুনিয়ায় জানান দিয়েছে, তারা কতোটা নৃশংস হতে পারে। এ ঘটনার পর বোধকরি কোনো সুস্থ-স্বভাবিক মানুষেরই সুস্থ থাকার কথা নয়। এ ঘটনার বিষয়ে প্রশাসন অবগত ছিল। চারদিন আগে সেখানে শুক্রবারের ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পদক্ষেপ যা ছিল তা তো দেশবাসী দেখেছে।
শুক্রবার রাতটি নির্ঘুম কেটেছে। শনিবারের দিনটি কেমন যাবে? দিন শেষ রাতেই বা কী অপেক্ষা করছে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন সকলের কাছেই। শুক্রবার ছুটির দিন সকলে যখন পরিবার নিয়ে আনন্দ আর বিনোদনে কাটাবে তখন দেশের কোটি কোটি মানুষ ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা অসংখ্য মানুষের চোখ আটকে যায় রাজবাড়ীর খবরে। সেখানে নুরাল পাগলার মাজারে চলেছে লাশ নিয়ে উন্মত্ততা, জিঘাংসা। প্রকাশিত ঘটনার ভিডিও ফুটেজে যে দৃশ্য তামাম দুনিয়া দেখেছে তা আসলে কী বার্তা দেয়?
একইদিনে রাজশাহীর পবা উপজেলায় খনকার শরীফে হামলা ও ভঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। চলেছে তৌহিদী জনতার হল্লা। পাশেই দাঁড়িয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যেমনটি ঘটেছে রাজবাড়ীতেও। সেখানকার অসংখ্য ফুটেজে দেখা যায় যৌথ বাহিনীর উপস্থিতি, কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটেছে।
ফিরে দেখুন, রংপুরের গঙ্গছড়ায় কী ঘটেছিল? রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে এক দঙ্গল মানুষরূপি পশু উৎসব করে পিটিয়ে হত্যা করেছে। মবের ভয়ে পুলিশ দেখেও তাদের বাঁচাতে যায়নি। এরপর এসে তারা দায়িত্ব সেরেছে লাশ নিয়ে। কতোটা জঘন্যতম অপরাধ ভাবা যায়? পুলিশ দেখছে দুজন মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে আর তা দেখেও তারা চলে গেছে। এতোটা অন্ধ, বধির সরকার, প্রশাসন হয় কী করে? এরপর যদিও ভিডিও দেখে মারধরে জড়িত অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে কিন্তু গ্রেপ্তার নেই।
লালমনিরহাটে বৃদ্ধ নাপিত পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মব তৈরি করে যে মারধর করা হয়েছে, এটাও কি সভ্য সমাজে কাম্য? কারও বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ থাকলে আইন আদালত আছে, থানা পুলিশ আছে। কিন্তু যেভাবে সেই পিতা-পুত্রকে মারা হয়েছে, জেলে ভরা হয়েছে তা নিন্দা জানাবার ভাষা অভিধানে নেই। আর অদ্ভূত হচ্ছে ঘটনার মাসের পর মাস যায় তারা কবে মুক্তি পাবে তার ইয়ত্তা নেই। সরকারের তরফেও এ বিষয়ে কোন রা নেই। কারণ সেখানেও তৌহিদী জনতা ঢুকে গেছে।
সাধারণ মানুষ মাত্রই চরম নিরাপত্তাহীনতায়। রংপুর, দিনাজপুরের পর চট্টগ্রামেও এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাকে পানি পর্যন্ত খেতে দেয়া হয়নি। সেই মায়ের কান্নার কি জবাব দেবে রাষ্ট্র?
প্রথমদিকে মবের একটি রাজনৈতিক কালার দেয়ার চেষ্টা হয়েছে এবং সবকিছু আদায়ে মবকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সকল দাবি, অদাবি আর কুদাবি আদায়ে মবই যেন হাতিয়ার। কারণ সরকার নিজেই বলেছে, মব হচ্ছে এক ধরনের প্রেসার গ্রুপ। আর যায় কোথায়? একের পর এক মব চলছে। কিন্তু কোন পথে যাচ্ছে স্বদেশ?
ঘটনার পর হালের জনপ্রিয় এক টেলিভিশন উপস্থাপক লিখেছেন, বিবৃতিগুলো ভালো, সরকারের হৃদয় আছে বোঝা যায় কিন্তু হাতও দেখি না, পা-ও দেখি না। শুধু বলে, নড়েও না, চড়েও না, অ্যাকশন নাই! মুখের কথায় চিড়া ভিজলে আজ এমন মধ্যযুগীয় ঘটনা দেখতে হতো না। কোথায় ছিলাম জানি, কোথায় আছি তা জানি না, কোথায় যাচ্ছি তাও জানি না।
একটি প্রধান জাতীয় দৈনিকে কর্মরত এক সহকর্মী লিখেছেন, একটা দেশ, একটা সমাজ, একটা রাষ্ট্র, একটা শাসনব্যবস্থা অধঃপতনের কোন পর্যায়ে গেলে একজন মৃত মানুষের, একজন মুসলিম মানুষের লাশ কবর থেকে তুলে তাকে পুড়িয়ে দেওয়া যায়?
অবশ্য, উত্তেজিত ছাত্র-জনতা তো তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেই। কিন্তু, সেই সব উল্লাসমুখর জীবকে কি মানুষ বলা যায়?
এই প্রশ্নটি বোধকরি সকলেরই। যারা রাজবাড়ীতে ধর্মের নামে এ ধরনের পাশবিকতা প্রদর্শন, লাশ পুড়িয়ে উল্লাস করেছেন তারা কি আসলেই মানুষ?

No comments