গাজায় ভয়াবহ হামলা, পালাচ্ছে মানুষ, মাটি কামড়ে পড়ে আছেন কেউ কেউ

ইসরাইলি বিমান ও ট্যাঙ্ক গাজা শহরের পূর্ব ও উত্তর প্রান্তে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ভবন ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। ইসরাইলি নেতারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে, শহরের ওপর সম্প্রসারিত বৃহৎ আকারের সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শনিবার রাত থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত গাজা শহরের জয়তুন ও শুজাইয়া এলাকায় টানা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এদিকে, ট্যাঙ্কগুলো কাছাকাছি সাবরা এলাকায় ঘরবাড়ি ও রাস্তায় গোলা নিক্ষেপ করেছে। উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়া এলাকায় কয়েকটি ভবন উড়িয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরণের দিক থেকে আকাশে আগুনের আলো ছড়িয়ে পড়ে।

আতঙ্কে বহু পরিবার শহর ছাড়তে শুরু করে। তবে অনেকে বলেছেন, তারা মরতে রাজি কিন্তু শহর ছাড়বেন না। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এপি। গাজা শহরে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ মানুষের অর্ধেকের বসবাস। এর মধ্যে কয়েক হাজার ইতিমধ্যে গাড়ি ও রিকশায় করে বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছেন। ৪০ বছর বয়সী মোহাম্মদ রয়টার্সকে বলেন, কতবার আমার স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বের হতে বাধ্য হয়েছি, তার হিসাবই হারিয়ে ফেলেছি। কোথাও নিরাপদ নয়, কিন্তু ঝুঁকি নিতে পারি না। যদি হঠাৎ আক্রমণ শুরু হয়, তারা ভারী গোলাবর্ষণ করবে। অন্যদিকে, কেউ কেউ বলেছেন, তারা কোনোভাবেই গাজা শহর ছাড়বেন না। ৩১ বছর বয়সী আয়াহ বলেন, আমরা যাচ্ছি না। ওরা চাইলে আমাদের ঘরে মেরে ফেলুক। আমরা আটজন একসঙ্গে থাকি। একটি তাঁবু কেনার কিংবা যাতায়াত খরচ দেয়ার সামর্থ্য নেই। আমরা ক্ষুধার্ত, ভীত আর নিঃস্ব। এ মাসের শুরুর দিকে ইসরাইল গাজা শহর দখলের জন্য বৃহৎ আকারের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শহরের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কেন্দ্রস্থলে সেনারা প্রবেশ করবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী মিশর ও কাতার যুদ্ধবিরতির আলোচনা পুনরায় শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবুও ইসরাইলি বাহিনী শহর ও আশপাশের এলাকায় গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। রবিবার সেনারা জানায়, সম্প্রতি তারা জাবালিয়ায় আবারও যুদ্ধ শুরু করেছে। রবিবার ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল ক্যাটজ অভিযানে অটল থাকার ঘোষণা দেন। শুক্রবার তিনি হুমকি দেন, হামাস যুদ্ধ শেষ করে ইসরাইলের শর্ত মেনে সব জিম্মিকে মুক্তি না দিলে গাজা শহরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। হামাস রবিবার জানায়, গাজা শহর দখলের পরিকল্পনা প্রমাণ করে ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চায় না।

বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধবিরতিই জিম্মিদের ফেরানোর একমাত্র পথ এবং তাদের জীবনের দায়িত্ব ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। জাতিসংঘ সমর্থিত বিশেষজ্ঞরা শুক্রবার ঘোষণা করেন গাজা শহর ও আশপাশে সম্পূর্ণ মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষ চলছে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি পুরোপুরি মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ বন্ধ করা এবং উল্টে দেয়া সম্ভব। বলা হয়েছে ‘তর্ক-বিতর্কের সময় শেষ, এখন অনাহার বিদ্যমান এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হয় এবং মানবিক সাহায্য গাজা উপত্যকায় পৌঁছাতে না পারে। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পানি-স্যানিটেশন সেবা যদি দ্রুত পুনঃস্থাপন না হয়। তবে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সংখ্যা বহুগুণে বাড়বে।

রবিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, অপুষ্টি ও অনাহারে আরও ৮ জন মারা গেছেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ ধরনের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৯, যার মধ্যে ১১৫ জন শিশু। গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা জানিয়েছে, রবিবার ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৪২ জন নিহত হয়েছেন। সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, গাজা শহরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিমান হামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাবরায় একটি হামলায় ৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া গোটা উপত্যকায় হামলার খবর পাওয়া গেছে। ইসরাইল এখন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগের মুখে। এখন পর্যন্ত তারা গাজায় ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ হত্যা করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইতিমধ্যে নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। একইভাবে হামাস সামরিক প্রধান মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে তার মৃত্যুর পর তা প্রত্যাহার করা হয়। এপি জানায়, রোববার গাজা শহরের দক্ষিণে খাদ্য সহায়তা নিতে যাওয়া চারজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনারা। ওই জায়গাটি সামরিক নিয়ন্ত্রিত এলাকা হলেও ফিলিস্তিনিরা নিয়মিত খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে যেতে সেখানে যাতায়াত করে।

No comments

Powered by Blogger.