রাজবাড়ীতে নুরাল পাগলার দরবার থমথমে, থানায় অভিযোগ দেয়নি পরিবার
গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দফায় দফায় নুরাল পাগলার দরবারে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা শরিয়ত পরিপন্থীভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেন।
উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোকের এই হামলায় ১০–১২ জন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। পুলিশের দুটি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। হামলায় আহত হয়ে মারা যান এক ব্যক্তি।
পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর ঘটনায় গোয়ালন্দ ঘাট থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাতে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। যদিও এ মামলায় আজ শনিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার নেই। প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিবুল ইসলাম।
নুরাল পাগলার দরবারে হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি বলে জানান ওসি।
আজ সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ান মোল্লা পাড়ায় অবস্থিত নুরাল পাগলার দরবারের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ আছে। উৎসুক জনতা ভিড় করছে। দরবারের ভেতর একটি তিনতলা এবং একটি দুইতলা ভবন।
তিনতলা ভবনে পরিবারসহ নুরাল পাগলা থাকতেন। দুটি ভবনের সব কটি কক্ষ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আসবাবপত্র সব খোয়া গেছে। অবশিষ্ট জিনিসপত্র ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভবন থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে নুরাল পাগলার আস্তানা। সেখানে একটি টিনশেড ঘরে বসে ভক্তদের সঙ্গে সময় কাটাতেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর আগে টিনশেড ঘরসহ সমতল ভূমি থেকে কয়েক ফুট উঁচু করে বেদি তৈরি করা হয়। বেদির ওপর একপাশে টিনশেড ঘরে তিনি বসে সময় কাটাতেন। অপর পাশে মৃত্যুর পর তাঁকে কবর দেওয়া হয়। দরবারের ভেতর এখন ধ্বংসস্তূপ। ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। কেউ কেউ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ থেকে চাল–ডালসহ জিনিসপত্র কুড়িয়ে নিচ্ছেন। পুলিশ মাঝেমধ্যে উৎসুক জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছে।
কুষ্টিয়ার পোড়াদাহ থেকে এসেছেন আবুল হোসেন (৬০) নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার দেশের আলোচিত খবর ছিল নুরাল পাগলার দরবারে হামলা। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে খবরটি দেখে আর থাকতে পারলাম না। কী হয়েছে দেখতে রাতে গোয়ালন্দে এক আত্মীয়ের বাড়ি আসি। আজ সকালে দরবারে এসে দেখে গেলাম। তাঁর কাজ বিতর্কিত ছিল, তাই বলে লাশ কবর থেকে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি।’
রাজবাড়ীর পাংশা থেকে আসা রত্না বিশ্বাস বলেন, ‘তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন বলে তাঁকে আমরা প্রণাম করতাম। দরবারে হামলার কথা শুনে দেখতে এসেছি।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২৩ আগষ্ট বার্ধক্যের কারণে মারা যান নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলা। ওই দিন রাতে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় আস্তানায় তাঁর লাশ দাফন করেন ভক্তরা। এরপর বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কবর সমতল করারসহ কয়েকটি দাবি জানায় স্থানীয় আলেমসহ তৌহিদি জনতা।
এ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি ও নুরাল পাগলার পরিবারের কয়েক দফা বৈঠক হয়। তবে কবর নিচু না করায় দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয় ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। তারা সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতল করাসহ বিভিন্ন দাবি জানায়। অন্যথায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, বেলা তিনটার দিকে মঞ্চ থেকে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, সদস্যসচিব বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী খান সবাইকে সমাবেশে থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু উত্তেজিত লোকজন মিছিল নিয়ে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা করেন। ভেতর থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন নুরাল পাগলার ভক্তরা। এ সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন।
এ সময় কিছু লোক দরবারের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেন এবং মালামাল লুটপাট করেন। একপর্যায়ে বিকেল পাঁচটার দিকে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে গোয়ালন্দ পদ্মার মোড়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ওপর নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
সংঘর্ষে আহত রাসেল মোল্লা নামের নুরাল পাগলার এক ভক্ত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তিনি গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম তেনাপচা গ্রামের আজাদ মোল্লার ছেলে।
![]() |
| নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবারের ভেতর শুক্রবার হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। আগুন ধরিয়ে সব পুড়িয়ে দেয়। আস্তানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ধংসস্তুপ। শনিবার সকালে। ছবি: প্রথম আলো |

No comments