নেপালের তরুণেরা কেন থামছে না? by চার্লি ক্যাম্পবেল

নেপালে গত সপ্তাহে শুরু হয় গণবিক্ষোভের ডাক, যা আরও তীব্র হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের নিষেধাজ্ঞার পর। মঙ্গলবার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও এবং প্রধানমন্ত্রী খাদগ প্রাসাদ শর্মা অলি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের পদত্যাগের পরও বিক্ষোভ থামেনি। নেপাল থেকে স্বৈরশাসকেরা কী শিক্ষা পেতে পারেন, তা নিয়ে লিখেছেন টাইম–এর এডিটর অ্যাট লার্জ চার্লি ক্যাম্পবেল

সেনা-নিয়ন্ত্রিত কারফিউ ঘোষণার পর বুধবার নেপালে এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তার আগে দুই দিন ধরে চলা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজধানী কাঠমান্ডু ও অন্যান্য শহর অচল হয়ে পড়ে।

মূলত তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভকারীরা টায়ার জ্বালানো, পার্লামেন্ট, মন্ত্রণালয় ও সরকারি অফিসে ভাঙচুর এবং রাজনীতিবিদদের বাড়িতে হামলা চালান। এমনকি মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে হেলিকপ্টারেরও প্রয়োজন হয়।

এই সহিংসতায় অন্তত কমপক্ষে ২২ জন প্রাণ হারান এবং শত শত মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আহত হন। সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশাধিকার বন্ধের চেষ্টাকে এই সহিংসতার তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশটির প্রায় তিন কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ, যা জন্ম নিয়েছে রাজনৈতিক দুর্নীতি ও ব্যাপক বৈষম্যের বিরুদ্ধে।

২.

নেপাল সরকার ফেসবুক, ইউটিউব, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, সেগুলো নিবন্ধন ও সরকারি নজরদারির নিয়ম মানেনি।

কিন্তু বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, এটি মূলত তরুণদের ক্ষোভ দমন করার পদক্ষেপ। তরুণেরা ক্ষুব্ধ ছিলেন রাজনৈতিক অভিজাতদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে, যা অনলাইনে প্রদর্শিত হচ্ছিল, যাঁদের ‘নেপো কিডস’ বলা হচ্ছে।

সাধারণ নেপালি জনগণ যে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে অনলাইনে অভিজাত পরিবারের সন্তানদের জৌলুশপূর্ণ জীবনযাপনের বৈপরীত্য ক্রমে ক্ষোভ বাড়ায়।

গত সপ্তাহে শুরু হয় গণবিক্ষোভের ডাক, যা আরও তীব্র হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের অদক্ষ নিষেধাজ্ঞার পর। মঙ্গলবার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও এবং প্রধানমন্ত্রী খাদগ প্রাসাদ শর্মা অলি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের পদত্যাগের পরও অশান্তি কমেনি।

ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘নেপালের সরকার আসলে নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিধিনিষেধ ব্যবহার করে এই ধরনের পরিস্থিতি ঠেকাতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্পূর্ণ উল্টো ফল দিয়েছে।’

৩.

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জন–আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি এশিয়ার জন্য নতুন নয়। ইন্টারনেট ইতিমধ্যেই ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সরকার পতনের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি আজও এটি ইন্দোনেশিয়ায় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

তবে এই ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত হয়েছিল ২০১০ সালের আরব বসন্তে, যখন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় অনলাইনে সংগঠিত এক ধারাবাহিক সরকারবিরোধী আন্দোলন ঝড় তোলে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি এক স্পষ্ট পূর্বাভাস; আরব বসন্তের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশাধিকার বন্ধ করার প্রচেষ্টা যেন ‘এক হাইড্রার মাথা কাটার’ মতো কাজ করেছিল।

এতে রাষ্ট্রের প্রকাশ্য বাক্‌স্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার অস্বীকার করার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিক্ষোভকারীদের অভিযোগকে বৈধতা দেয় এবং তাদের দাবির প্রতি সহানুভূতি আরও বাড়ায়।

৪.

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আরব বসন্তের পর অনেক স্বৈরশাসক দেশে কঠোর ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু করে। নেপালের উত্তর সীমান্তের ওপারে চীনের গ্রেট ফায়ারওয়াল হয়ে ওঠে কড়াভাবে নিয়ন্ত্রিত অনলাইন স্পেসের প্রতীক। গ্রেট ফায়ারওয়াল কেবল ‘অবাঞ্ছিত বাইরের তথ্য’ই আটকায় না, দেশীয় রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়ও ছেঁটে ফেলে এবং নিষিদ্ধ করে।

তবে গ্রেট ফায়ারওয়াল হলো চীনের বহুস্তরীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার একটি অংশমাত্র। সেখানে ব্রডব্যান্ড সংযোগ বা মোবাইল সিম কার্ড কিনতে হলে সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র প্রয়োজন।

এমনকি পাবলিক ওয়াই–ফাই ব্যবহার করতে হলেও ফোন নম্বর যাচাই করতে হয়, যা আবার জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত। আর চীনের সর্বব্যাপী মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম উইচ্যাট ব্যবহারকারীদের এক শতাধিক সদস্যবিশিষ্ট গ্রুপে যোগ দিতে হলে ব্যাংক তথ্য নিবন্ধন করতে হয়।

এই বহুবিধ যাচাইয়ের কারণে অনলাইন ফোরামে নামবিহীন পোস্টও আইনি পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ফলে তৈরি হয়েছে একধরনের সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয়, দমন-পীড়ন হয় দ্রুত ও কঠোরভাবে।

যেমন ২০২৩ সালের নভেম্বরে চীনের সাংবাদিক ও কর্মী সান লিন পুলিশের মারধরে মারা যান। তিনি প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনামূলক পোস্ট করেছিলেন।

পরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি অনলাইনে তাঁর মৃত্যু নিয়ে যেকোনো আলোচনা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্রমবর্ধমানভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করা হচ্ছে দ্রুত আপত্তিকর কনটেন্ট শনাক্ত ও মুছে ফেলার জন্য।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পার্ক স্ট্র্যাটেজিসের এশিয়া অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শন কিং মন্তব্য করেন, বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা হয়তো কাঠমান্ডুর সহকর্মীদের দিকে করুণা ও আনন্দ নিয়ে তাকাচ্ছেন। তাঁরা মনে মনে কৃতজ্ঞ হচ্ছেন যে মূল ভূখণ্ড চীনের নেটিজেনরা কখনোই সেই জিনিস মিস করে না, যার জন্য নেপালি জনগণ এত কঠিন লড়াই করছে।

৫.

কেবল স্বৈরচারী রাষ্ট্রগুলোই নয়, তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশও অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে।

ফ্রিডম হাউসের ২০২৪ সালের ফ্রিডম অন দ্য নেট প্রতিবেদনের মতে, গত বছর টানা ১৪তম বারের মতো বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে। সমীক্ষাকৃত বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৭ শতাংশ এখন উন্মুক্ত ও মুক্ত ইন্টারনেট ভোগ করছে।

নেপালের অপর প্রান্তে, স্বৈরতান্ত্রিক চীনের বিপরীতে, ভারত হয়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের এক পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র—কীভাবে অনলাইন বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে ক্রমশ জটিল কৌশল প্রয়োগ করছে, তা দেখানোর জন্য।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সাল থেকে ভারত তার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা জোরদার করেছে, যেখানে এখন কেবল আইটি বা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় নয়, বরং আরও অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে সরাসরি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছে কনটেন্ট অপসারণের নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারত সরকার একটি ‘ফ্যাক্ট-চেকিং ইউনিট’ গঠনের উদ্যোগ নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল কথিত ভুয়া রিপোর্টিং সংশোধন করা। তবে সাংবাদিক ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে ছিল। এরপরও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ব্যঙ্গ করে আঁকা কার্টুন থেকে শুরু করে প্রাণঘাতী পদদলনের খবর পর্যন্ত সবই অপসারণের ওই নির্দেশনার আওতায় এসেছে।

৬.

অবশ্যই সম্পূর্ণ অবারিত ও নিয়ন্ত্রণহীন ইন্টারনেটও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যেমন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যায় অনলাইনে ঘৃণা ও ভ্রান্ত তথ্য প্রচার ছিল অন্যতম কারণ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া–বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ সব সময় একধরনের দ্বিমুখী অস্ত্রের মতো। কারণ, কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই সহিংসতা উসকে দিতে পারে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে।

নেপালের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা অনিশ্চিত। দেশটির জনগণ মাথাপিছু বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে এখনো ১ হাজার ৪০০ ডলারের নিচে অবস্থান করছে এবং জীবনযাত্রা নিয়ে সংগ্রাম করছে। আর যুব বেকারত্ব প্রায় ২০ শতাংশ। ফলে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি তরুণ দেশ ছাড়ছেন বিদেশে কাজের সন্ধানে, প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে।

বিক্ষোভকারীরা দাবি তুলেছেন, সংসদ ভেঙে দেওয়া, সংসদ সদস্যদের গণপদত্যাগ, বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশদাতা কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক বরখাস্ত এবং নতুন নির্বাচনের আয়োজন। তবে শুধু এসব দাবি পূরণ করলেই নেপালের সমস্যার সমাধান হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

অন্তত এই আশা করা যায় যে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমালোচনা উপেক্ষা না করে তা শোনার অভ্যাস করবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলোর জন্য কিংবা যারা স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগোতে চায়, তাদের উল্টো শিক্ষা হলো ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াই অস্তিত্বের ঝুঁকি। কারণ, একবার বোতলের ভেতর থেকে দৈত্য বেরিয়ে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না, আর তা চেষ্টা করলে বরং আগুনে ঘি ঢালার মতো হয়।

মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ক্ষোভ আর রাগ কোনো বিস্ময়ের বিষয় হওয়া উচিত নয় নেপালের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে, যদি তাঁরা কেবল বিক্ষুব্ধদের কথা শোনার সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু প্রায়ই যা ঘটে, সমস্যাগুলো সমাধান করার পরিবর্তে সরকারগুলো সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার পথই বেছে নেয়।

* চার্লি ক্যাম্পবেল, টাইম–এর এডিটর অ্যাট লার্জ
- টাইম–এর অনলাইন সংস্করণ থেকে নেওয়া, অনুবাদ: মনজুরুল ইসলাম

দেয়ালের একটি গ্রাফিতিতে লেখা ‘হত্যাকারীকে ফাঁসিতে ঝোলাও’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের পর অনেকটা শান্ত নেপাল। কাঠমান্ডু, ১১ সেপ্টেম্বর
দেয়ালের একটি গ্রাফিতিতে লেখা ‘হত্যাকারীকে ফাঁসিতে ঝোলাও’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের পর অনেকটা শান্ত নেপাল। কাঠমান্ডু, ১১ সেপ্টেম্বর। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.