ফিলিস্তিন ইস্যুতে যেভাবে অস্ট্রেলিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কে চূড়ান্ত ভাঙন by কাউসার খান
ঘটনার গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে, তা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছে। তবে এখানে সিডনিতে বসে বুঝতে পারছিলাম একটি বড় পরিবর্তনের সাক্ষী হতে যাচ্ছি আমরা। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নজিরবিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং পাল্টা ভিসা বাতিলের পদক্ষেপে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
সিডনিতে এই কূটনৈতিক দাবানলের উত্তাপ সরাসরি অনুভব করা যাচ্ছে। এটি আর শুধু সংবাদপত্রের শিরোনাম নয়, বরং এখানকার ক্যাফে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ মানুষের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু একটি কূটনৈতিক অবস্থান নয়, বরং অস্ট্রেলিয়ার আত্মপরিচয় এবং বিশ্বমঞ্চে তার ভূমিকা নিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই অস্ট্রেলিয়া তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ এবং ঐতিহাসিক মিত্র। কিন্তু এক বছর ধরে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরছিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ব্যাপক সহানুভূতি পেয়েছিল। কিন্তু এরপর গাজায় তাদের সর্বাত্মক ধ্বংস অভিযান সেই সহানুভূতিকে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে ফেলেছে। গাজার অনাহার এবং ধ্বংসের ছবি বিশ্বজুড়ে মানুষের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে, যা অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি মানবতাবাদী দেশকে তার অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য করেছে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত সেই পরিবর্তনেরই চূড়ান্ত রূপ।
তবে এটা ঠিক, এই উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলেছে অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টনি বার্কের সিদ্ধান্ত। ইসরায়েলি নেসেট (ইসরায়েলের জাতীয় সংসদ) সদস্য সিমচা রথম্যানের ভিসা বাতিল করা। রথম্যান, যিনি ফিলিস্তিনি শিশুদের ‘শত্রু’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, তাঁর ভিসা বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে।
টনি বার্কের কথায়, ‘শক্তি পরিমাপ করা হয় কতজনকে আপনি মারতে পারেন বা কত শিশুকে ক্ষুধার্ত রাখতে পারেন, তা দিয়ে নয়।’ এই বক্তব্য রাজনৈতিক বিবৃতির চেয়েও বেশি একটি নৈতিক অবস্থানের প্রকাশ। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের ভিসা বাতিল করা আর কোনো সাধারণ মানুষের ভিসা বাতিল করা কি এক? অবশ্যই নয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া এখানে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তাদের বহুসাংস্কৃতিক সমাজে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের কোনো স্থান নেই, তা সে যে–ই হোক না কেন। এটি অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার একটি নীতিগত পদক্ষেপ, কোনো দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নয়।
অন্যদিকে নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল নজিরবিহীন। তিনি আলবানিজকে ‘দুর্বল’ এবং ‘অস্ট্রেলিয়ার ইহুদিদের ত্যাগকারী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আলবানিজকে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল এবং দেশের ভেতরে ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণ করা। কিন্তু ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। নেতানিয়াহুর এই আক্রমণ অস্ট্রেলিয়ায় একধরনের জাতীয় ঐক্য তৈরি করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলের নেতা, যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক, তাঁরাও একজন বিদেশি নেতার কাছ থেকে নিজেদের প্রধানমন্ত্রীর এমন ব্যক্তিগত আক্রমণে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছেন। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতারাও নেতানিয়াহুর মন্তব্যকে ‘অশোভন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। নেতানিয়াহু ভেবেছিলেন, তিনি আলবানিজকে একঘরে করে দেবেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজেই অস্ট্রেলিয়ায় ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনকে আরও দুর্বল করে ফেলেছেন।
বিশ্লেষক মনে করছেন, নেতানিয়াহুর এই তীব্র প্রতিক্রিয়ার পেছনে তাঁর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট একটি বড় কারণ। ৭ অক্টোবরের গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন এবং তাঁর জোট সরকার টিকে আছে রথম্যানের মতো কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের সমর্থনের ওপর। এই পরিস্থিতিতে বাইরে একটি শক্তিশালী ভাবমূর্তি ধরে রাখা তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য জরুরি। তাই অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি বন্ধুপ্রতিম দেশকে আক্রমণ করে তিনি হয়তো নিজের দেশের কট্টরপন্থীদের এই বার্তাই দিতে চাইছেন যে তিনি ইসরায়েলের স্বার্থে কারও সঙ্গে আপস করবেন না।
আবার অস্ট্রেলিয়ার এই নীতিগত পরিবর্তনের পেছনে জনমতের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এ মাসের প্রথম দিকে সিডনির আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ফিলিস্তিনের জন্য যে জনসমুদ্র দেখা গেছে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাতে এবং গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিবাদে সিডনির আইকনিক হারবার ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে এক অবিস্মরণীয় জনসমুদ্র, যা এই শহরের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ফলে অস্ট্রেলিয়া সরকারও আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আর দ্বিধায় থাকেনি।
এই পুরো বিষয় শুধু অস্ট্রেলিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখন তার কিছু নিকটতম মিত্রদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা এবং এখন অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো যখন দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে এমন জোরালো অবস্থান নিচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র একা হয়ে পড়ছে বললে খুব একটা ভুল হবে না। বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যেখানে মধ্যম শক্তিধর দেশগুলো আর বড় শক্তিগুলোর দেখানো পথে হাঁটতে সব সময় রাজি নয়।
অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নয়। এটি একটি নতুন আন্তর্জাতিক বাস্তবতার প্রতিফলন, যেখানে দেশগুলো তাদের নৈতিক অবস্থান এবং পরিবর্তনশীল জনমতের ভিত্তিতে স্বাধীন নীতি গ্রহণ করছে। নেতানিয়াহুর তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং ভিসা যুদ্ধের মতো পদক্ষেপ দেখলেই বোঝা যায় এই স্বীকৃতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
একটি দুর্বল বা গুরুত্বহীন পদক্ষেপ হলে এত তীব্র প্রতিক্রিয়া আসত না। অস্ট্রেলিয়ার এই সাহসী পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে, যেখানে নৈতিক অবস্থান এবং মানবাধিকারের চেয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। সময় বলে দেবে, এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত কী ভূমিকা রাখে, তবে এটি যে বিশ্বমঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থানকে নতুন করে চিনিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
* কাউসার খান, প্রথম আলোর সিডনি প্রতিনিধি ও অভিবাসন আইনজীবী
![]() |
| ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ |

No comments