সন্ধিক্ষণে দক্ষিণ এশিয়া: কোন পথে ভারত-পাকিস্তান by আসিম সাজ্জাদ আখতার

প্রায় আট দশক আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। এর মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইতিহাসের সেই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের সামনে নতুন সুযোগ খুলে গিয়েছিল।  ভেবেছিলাম, হয়তো আমরা নিজেদের ভাগ্য নতুনভাবে গড়তে পারব। কিন্তু সেই আশার অনেকটাই ভেস্তে গেছে; বরং দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের মূল সুর হয়ে উঠেছে সন্দেহ, শত্রুতা আর যুদ্ধের হুমকি।

আজ আমরা যখন প্রায় ৮০ বছরের সেই ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তখন দেখতে পাই, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের জট শুধু বেড়েছেই। এর সঙ্গে নতুন নতুন ঝামেলা যোগ হয়েছে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, ধর্মীয় উগ্রতা এবং সামরিকতাবাদ উভয় রাষ্ট্রের ভেতরে শক্তভাবে শিকড় গেড়েছে।

তরুণ প্রজন্ম, যাদের হাতে ভবিষ্যৎ, তারাও এই ঘৃণার রাজনীতির প্রভাবে বড় হচ্ছে। তারা পারস্পরিক ইতিহাস, যৌথ ঐতিহ্য বা ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবতে চায় না। যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের উত্তেজনা তাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা। তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার এই বৃহত্তম ও জনবহুল অঞ্চলের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? বিশ্লেষকেরা অন্তত তিনটি সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরেন।

প্রথম এবং সবচেয়ে সম্ভাব্য দৃশ্যপট হলো বর্তমানের ধারাবাহিকতা। ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আরও গভীরভাবে সমাজে প্রভাব ফেলবে। বিজেপি, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সংগঠনগুলো কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র ও সাংস্কৃতিক পরিসরেও আধিপত্য বিস্তার করবে।

পাকিস্তানে সামরিক প্রভাব বা ‘খাকিরাজ’ আরও শক্ত হবে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত সেনাশক্তির ছায়াতলে কাজ করবে। একই সঙ্গে ধর্মীয় ডানপন্থী শক্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বাড়াবে। এই প্রক্রিয়ায় দুই রাষ্ট্রই তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই কিংবা জাতীয় ঐক্যের নামে আরও বেশি ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করবে। ফলাফল হবে, ঘৃণার রাজনীতি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা কিছুটা আশার আলো দেখায়। ভারতে হয়তো কংগ্রেস বা তাদের সহযোগীরা আবারও ক্ষমতায় আসতে পারে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কিছু প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারে। পাকিস্তানেও রাজনৈতিক দলগুলো সেনাশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়তে পারে, যা অন্তত কিছু সময়ের জন্য শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু এ আশাও সীমিত। কারণ, এই মধ্যপন্থী বা উদারপন্থী শক্তিগুলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে না। তারা একই উন্নয়ন মডেলের সঙ্গে যুক্ত, যা কিনা ভোগবাদ, পরিবেশবিধ্বংস আর বৈষম্যকে আরও বাড়ায়। ফলে তাদের নেতৃত্বও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয়ে উঠতে পারে না। একসময় আবারও উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সামরিকতাবাদী শক্তিই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

তৃতীয় সম্ভাবনা সবচেয়ে কম বাস্তবসম্মত হলেও সবচেয়ে জরুরি। সেটি হলো সাধারণ মানুষের ঐক্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রগতিশীল রাজনীতি। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমজীবী মানুষ, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে যদি নতুন ধরনের রাজনৈতিক জোট গড়ে ওঠে, তবে স্থায়ী শান্তি ও সহযোগিতার পথ খোলা যেতে পারে। এর জন্য দরকার একটি বিকল্প অর্থনৈতিক দর্শন, যেখানে অগ্রাধিকার পাবে জনগণের মৌলিক চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান। বহুজাতিক কোম্পানি, ধনী ব্যবসায়ী বা সামরিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা নয়, জনগণের কল্যাণই হবে মূল লক্ষ্য।

এই বিকল্প ভবিষ্যতের আরেকটি অপরিহার্য শর্ত হলো পরিবেশ পুনর্গঠন। উপমহাদেশের পাহাড়, সমভূমি, নদী-নালা ও উপকূলীয় অঞ্চল দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে। এই ধ্বংস কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতারও জন্ম দিচ্ছে। পরিবেশের এই সংকট সমাধান ছাড়া টেকসই উন্নয়ন ও স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।

তাই পরিবেশই হতে পারে নতুন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তবে এই ভবিষ্যৎ বাস্তবায়নের জন্য প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে নতুন করে নিজেদের পুনর্গঠন করতে হবে। ভারতে হিন্দিভাষী অঞ্চলের আধিপত্য ভাঙতে হবে। কাশ্মীরি, নাগা, আদিবাসী ও দক্ষিণ ভারতের জনগণকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে।

পাকিস্তানে বালুচ, পাখতুন, গিলগিট-বালতিস্তানি, কাশ্মীরি, সিন্ধি ও সারায়েকি জনগণের জাতীয় প্রশ্নকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি পাঞ্জাব ও অন্যান্য শহুরে অঞ্চলে শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতি জোরদার করতে হবে।

সবশেষে, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি আঞ্চলিক চেতনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। লাদাখ, বালতিস্তান, দুই কাশ্মীর, সিন্ধ, রাজস্থান, দুই পাঞ্জাব, দুই পাশের পাখতুন অঞ্চল কিংবা বালুচ ও নাগাদের স্বার্থকে যদি একসঙ্গে দেখা হয়, তবে একটি যৌথ মানবিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব। কেবল এভাবেই সাম্রাজ্যবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর আগ্রাসনকে ইতিহাসের আবর্জনার স্তূপে পাঠানো যাবে।

আজ দক্ষিণ এশিয়ার সামনে প্রশ্ন একটাই, আমরা কি ঘৃণার রাজনীতিকে স্থায়ী করতে চাই, নাকি সাধারণ মানুষের ঐক্য আর শান্তিকে সামনে নিয়ে আসব? সময়ের দাবি হলো দ্বিতীয় পথটি বেছে নেওয়া। কারণ, যুদ্ধ নয়, সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমেই প্রায় ২০০ কোটি মানুষের এই অঞ্চল টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগোতে পারবে।

* আসিম সাজ্জাদ আখতার, ইসলামাবাদের কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটির শিক্ষক
- দ্য ডন থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

ভারত–পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাতের কারণে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয় কাশ্মীরিদের
ভারত–পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাতের কারণে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয় কাশ্মীরিদের। ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.