ভারতে সস্তায় রুশ তেল আমদানির নেপথ্যে মুকেশ আম্বানি
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বলেন, যখন সবাই চাইছে ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত এবং চীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানির ক্রেতা হয়ে উঠেছে। যা সবকিছুকে খারাপ করে তুলছে। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্টও সিএনবিসিকে জানিয়েছেন, ভারতের সবচেয়ে ধনী কিছু পরিবার এই আমদানির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। এই রিপোর্টে আল জাজিরা ভারতের রুশ তেল আমদানির পুরো চিত্রটি তুলে ধরেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ।
ফিনল্যান্ড-ভিত্তিক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ) এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সবচেয়ে বড় রুশ অপরিশোধিত তেল আমদানিকারক মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০২১ সালে জামনগর রিফাইনারিতে মোট অপরিশোধিত রুশ তেল আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর এই পরিমাণ বেড়ে গড়ে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয় ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে জামনগর রিফাইনারি রাশিয়া থেকে ১৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে। যা গত বছরের তুলনায় ৬৪ শতাংশ বেশি। যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ইতিমধ্যেই চলতি বছর এত পরিমাণ তেল আমদানি হয়েছে যা ২০২৪ সালের মোট আমদানি থেকে মাত্র ১২ শতাংশ কম।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রাশিয়ার তেলের উপর মূল্যসীমা কার্যকর হওয়ার পর থেকেই এই আমদানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। যদিও মূল্যসীমার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার রাজস্ব কমানো, কিন্তু বাস্তবে এটি ভারতকে কম দামে তেল কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে মূল্যসীমার অপরিবর্তিত হার (গত তিন বছর ধরে ৬০ ডলার) এবং এর কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। রাশিয়া একটি শ্যাডো ফ্লিট বা গোপন জাহাজ বহর তৈরি করেছে, যা আন্তর্জাতিক নজরদারি এড়িয়ে ক্রেতাদের কাছে তেল সরবরাহ করে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতারা মূল্যসীমার চেয়ে বেশি দামে তেল কিনছে।
রিলায়েন্সের জামনগর রিফাইনারির আমদানি ও রফতানির তথ্য বিশ্লেষণ করে চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে আল জাজিরা। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গত মাস পর্যন্ত এই রিফাইনারি বিশ্বজুড়ে ৮৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পরিশোধিত তেল পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশ (৩৬ বিলিয়ন ডলার) রপ্তানি হয়েছে সেই দেশগুলোতে, যারা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ রপ্তানি হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ভুক্ত দেশে। যার মূল্য ১৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের তেল পণ্য গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। যার মধ্যে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের তেল প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে রুশ অপরিশোধিত তেল থেকে।
মূল্যসীমা কার্যকরের পর থেকে জামনগর রিফাইনারি থেকে চতুর্থ বৃহত্তম আমদানিকারক (মূল্যের দিক থেকে) যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে শীর্ষস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুর। তবে পরিমাণের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। যা জামনগর থেকে ৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন টন তেল পণ্য আমদানি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা মনে করা ভুল হবে যে ভারত কেবল একটি কোম্পানির লাভের জন্য এই বিপুল পরিমাণ শুল্কের বোঝা বহন করছে। সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো র্যাচেল জিয়েম্বা মনে করেন, সস্তায় রুশ তেল আমদানি ভারতের চলতি হিসাবের ঘাটতি কমাতে সাহায্য করেছে এবং একই সঙ্গে ভারত জোট-নিরপেক্ষ নীতি বজায় রেখেছে। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব ডনাল্ড ট্রাম্পের এই শুল্ককে একটি সম্পূর্ণ ধাপ্পাবাজি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, চীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। কারণ তিনি চীনকে ভয় পান। এটি মূলত অন্য রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপের একটি কৌশল।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে রুশ তেল থেকে প্রক্রিয়াজাত পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করদে যাচ্ছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। এটি কার্যকর হলে জামনগর রিফাইনারির রফতানি কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে, কারণ তাদের জেট ফুয়েল রপ্তানির অর্ধেকের বেশি ইউরোপে যায়। তবে রিলায়েন্স ডিসেম্বরে রোসনেফট এর সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা এই নিষেধাজ্ঞার পরে কীভাবে কার্যকর হয়, তা দেখার বিষয়।

No comments