দক্ষিণ ভারতে আড়াই হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার গোপন রহস্য উন্মোচন
এতে বলা হয়, বহুদিন ধরে ভারতের প্রাচীনতম নগর সভ্যতা হিসেবে সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতাকেই ধরা হতো। যার বিস্তার ছিল মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতে। কিন্তু কিলাডির প্রত্নতাত্ত্বিক খনন প্রমাণ করেছে যে, প্রায় একই সময়ে দক্ষিণ ভারতেও একটি উন্নত ও স্বাধীন সভ্যতা ছিল। এই সভ্যতার মানুষজন ছিল শিক্ষিত, দক্ষ কারিগর। এছাড়া আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যেও যুক্ত ছিল তারা। নতুন আবিস্কৃত সভ্যতার মানুষেরা ইটের তৈরি বাড়িতে বাস করতেন এবং মৃতদেহকে দৈনন্দিন সামগ্রীসহ মাটির পাত্রে সমাধিস্থ করতেন।
মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক জি কুমারাসন এবং তার দল এই খুলিগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য লিভারপুল জন মুরস ইউনিভার্সিটির ফেস ল্যাবের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেন। ফেস ল্যাবের বিশেষজ্ঞরা খুলিগুলোর ত্রিমাত্রিক (থ্রি ডি) স্ক্যান তৈরি করে তাতে পেশি, মাংস ও ত্বক যোগ করেন, যা মানুষের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় অনুপাত মেনে করা হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিচ্ছবিগুলোতে রঙ যোগ করা। গবেষকরা স্থির করেন, তারা বর্তমানে তামিলনাড়ুতে বসবাসকারী মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রঙ ব্যবহার করবেন। এই ডিজিটাল প্রতিচ্ছবিগুলো প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেয়। কারণ এটি ভারতের উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে বিদ্যমান পুরোনো জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসে। এতদিন ধরে প্রচলিত ধারণা ছিল যে, আর্যরা (উত্তর ভারতের আদি বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত) এই দেশের ‘আসল নাগরিক’। কিন্তু দ্রাবিড়ীয় (দক্ষিণ ভারতের আদি বাসিন্দা) সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে নতুন গবেষণা সেই ধারণার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে।
অধ্যাপক কুমারাসন বলেন, এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, আমরা যতটা ভাবি তার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় ছিল ওই সভ্যতা। আমাদের ডিএনএ-তে এর প্রমাণ রয়েছে। খুলি দুটির মুখের গঠনে প্রাচীন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। পাশাপাশি এতে মধ্য-প্রাচ্য ইউরেশীয় এবং অস্ট্রো-এশীয় জনগোষ্ঠীর ছাপও দেখা গেছে, যা প্রমাণ করে প্রাচীনকালে মানুষের মধ্যে বৈশ্বিক অভিবাসন ও সংমিশ্রণ ঘটেছে।
তবে কিলাডি নিয়ে গবেষণা এখানেই শেষ নয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই স্থান থেকে প্রায় ৫০টি সমাধিপাত্র খনন করেছেন এবং মানব দেহাবশেষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। যদিও হাড়গুলো খুবই জীর্ণ হওয়ায় ডিএনএ সংগ্রহ করা কঠিন, তবু গবেষকরা আশাবাদী। তারা মনে করেন, প্রাচীন ডিএনএ লাইব্রেরিগুলো অতীতের একটি দরজা খুলে দেয়, যা থেকে সেই সময়ের জীবনযাত্রা এবং আমাদের বর্তমানের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।
এই গবেষণা শুধু অতীতের রহস্য উন্মোচন করছে না, বরং ভারতের বহুমুখী সংস্কৃতি ও পরিচয়ের ওপর নতুন করে আলোকপাত করছে। এটি দেখায় যে, ভারত কোনো একক সংস্কৃতি বা জাতিগোষ্ঠীর দেশ নয়, বরং বিভিন্ন সভ্যতা ও মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ ভূমি। কিলাডির এই আবিষ্কার তাই শুধু তামিলনাড়ুর নয় বরং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।

No comments