গাজায় হাজার হাজার বেসামরিক ভবন নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরাইল

এ ধ্বংসযজ্ঞের বড় অংশই পরিকল্পিত বিস্ফোরণের মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ভবন নয়, অক্ষত ভবনও এর মধ্যে রয়েছে। যাচাই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইসরাইলি বাহিনী টাওয়ার ব্লক, স্কুল এবং অন্যান্য অবকাঠামোয় নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ চালাচ্ছে, যার ফলে ধুলা ও ধ্বংসাবশেষে চারদিক ঢেকে যাচ্ছে। বিবিসি ভেরিফাইকে একাধিক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ইসরাইল এই ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে বিবেচিত হতে পারে, যা অধিকৃত কোনো অঞ্চলের অবকাঠামো ধ্বংসকে নিষিদ্ধ করে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এক মুখপাত্র দাবি করেছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইনের সীমার মধ্যে থেকেই কাজ করছে এবং হামাস বেসামরিক এলাকায় ‘সামরিক অবকাঠামো’ লুকিয়ে রেখেছে। আইডিএফ বলেছে, কোনো সম্পত্তি ধ্বংস তখনই করা হয়, যখন তা সামরিক প্রয়োজনে অপরিহার্য।

রাফায় ধ্বংসের চিত্র
মিশর সীমান্তঘেঁষা রাফা শহরে ধ্বংসযজ্ঞ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহে ইসরাইলি বাহিনী ও তাদের ঠিকাদাররা শহরের বড় অংশ ধ্বংস করে ফেলেছে। শিক্ষাবিদ কোরি শার ও জামন ভ্যান ডেন হুকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এপ্রিলের পর থেকে গাজায় সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হয়েছে রাফা অঞ্চলেই। বিস্ফোরক, এক্সকাভেটর ও বুলডোজার দিয়ে এলাকা সমান করে ফেলা হয়েছে। জুলাই মাসে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরাইল কাটজ ঘোষণা দেন, রাফার ধ্বংসস্তূপের ওপর একটি ‘মানবিক শহর’ গড়ে তোলা হবে, যেখানে প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে আটকে রাখা হবে। এই পরিকল্পনা ব্যাপক নিন্দা কুড়িয়েছে। ইসরাইলি সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বিবিসিকে বলেন, এই প্রস্তাব ‘একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে।

স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ধ্বংস
বিবিসি ভেরিফাই মার্চের পর থেকে গাজায় ৪০টির বেশি জায়গায় অবকাঠামো ধ্বংসের ভিডিও শনাক্ত করেছে। তেল আল-সুলতান এলাকার একটি স্কুলসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ভবন এবং পৌরসভা ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। রাফার এই প্রাণবন্ত পাড়া একমাত্র বিশেষায়িত মাতৃসদন হাসপাতাল এবং এতিম শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য পরিচিত ছিল। স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, এই এলাকা আগেই বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবু অনেক ভবন টিকে ছিল। কিন্তু ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে ধ্বংসের মাত্রা বাড়ে, এমনকি খোলস রূপে থাকা ভবনগুলোকেও ধ্বংস করে ফেলা হয়। সৌদি পাড়া, যেখানে রাফার সবচেয়ে বড় মসজিদ ও অনেক স্কুল ছিল, সেখানেও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে।

সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গভীর অভ্যন্তরে ধ্বংস

ইসরাইলি বাহিনী কেবল সীমান্তবর্তী এলাকাই নয়, গাজার গভীরেও ভবন ধ্বংস করছে। খুজা’আ নামের একটি কৃষিপ্রধান শহর, যা ইসরাইল সীমান্ত থেকে ১.৫ কিমি দূরে, সেটিও প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধের আগে সেখানে প্রায় ১১,০০০ মানুষের বসবাস ছিল। আইডিএফ দাবি করেছে, তারা সেখানে ১২০০ ভবন ধ্বংস করেছে, যেগুলো হামাসের অবকাঠামো হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল। পাশের শহর আবাসান আল-কবিরাতেও (যেখানে প্রায় ২৭,০০০ মানুষ বাস করত) ব্যাপক ধ্বংস হয়েছে। ৩১ মে এবং ৮ জুলাইয়ের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, মাত্র ৩৮ দিনে বিশাল এলাকা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

মানবিক শহর না দখল?
গাজার পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলকে পৃথক করতে তৈরি করা হয়েছে নিরাপত্তা করিডোর, যার দু’পাশে ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ইসরাইল হয়তো ভবিষ্যতে স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় এই ধ্বংসের মাধ্যমেÑ নিরাপত্তা অঞ্চল গড়ে তুলে। কেউ কেউ মনে করছেন, রাফায় যে কথিত মানবিক শহর গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য এইভাবে এলাকা পরিষ্কার করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলেন, ইসরাইল এই ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের গাজা ছেড়ে চলে যেতে প্রলুব্ধ করতে চাইছে। জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রেসিডেন্ট এফরাইম ইনবার বলেন, এই ধ্বংস মানুষের মনে দেশ ছেড়ে যাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা তৈরি করতে পারে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এর আগে এমপিদের এক বৈঠকে বলেছেন, আমরা আরও ঘরবাড়ি ধ্বংস করছি Ñ যাতে ফিলিস্তিনিদের আর ফিরে যাওয়ার কিছু না থাকে।

গাজাবাসীর হৃদয়বিদারক বাস্তবতা
তেল আল-সুলতানের বাসিন্দা মোয়াতাজ ইউসুফ আহমেদ আল-আবসি বলেন, আমি যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে নতুন বাড়িতে উঠেছিলাম। খুব খুশি ছিলাম, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছিল। এখন সব ধ্বংস হয়ে গেছে। সবকিছু হারিয়ে আমি আর কোনো ঘর বা আশ্রয় পাই না। এই ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চলছে। ইসরাইলি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েক ডজন ডি৯ বুলডোজার পেয়েছে আইডিএফ। বাইডেন প্রশাসন এগুলোর রপ্তানি আগে স্থগিত রেখেছিল। এ ছাড়া মে মাস থেকে অনেক ইসরাইলি ফেসবুক গ্রুপে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞে ঠিকাদার চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে ‘ফিলাডেলফি করিডোর’ এবং ‘মোরাগ অ্যাক্সিস’-এর মতো আইডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। বিবিসি ভেরিফাই এসব ধ্বংসের জন্য সামরিক ব্যাখ্যা জানতে চাইলে আইডিএফ বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ডায়াকোনিয়া ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল’ সেন্টারের আইন বিশেষজ্ঞ ইইতান ডায়মন্ড বলেন, সামরিক প্রয়োজনের অজুহাতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ব্যবহারের ভিত্তিতে বেসামরিক সম্পত্তি ধ্বংস করা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন। অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল’ অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্ট-এর সহপরিচালক অধ্যাপক জানিনা ডিল বলেন, কোনো দখলদার শক্তির উচিত সেই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে শাসন করাÑ কেবল পুরো এলাকা বসবাসের অযোগ্য করে দেওয়ার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.