গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন: ‘মানবিক শহর’ ফিলিস্তিনিদের বন্দি শিবির: এহুদ ওলমার্ট by এমা গ্রাহাম-হ্যারিসন

ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট গার্ডিয়ানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাফার ধ্বংসাবশেষের ওপর যে ‘মানবিক শহর’ (হিউম্যানিটারিয়ান সিটি) গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা আসলে একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা বন্দিশিবির হবে। ফিলিস্তিনিদের সেখানে বন্দি করে রাখা জাতিগত নিধন (এথনিক ক্লিনসিং) বলে গণ্য হবে। ওলমার্ট বলেন, ইসরাইল ইতিমধ্যে গাজা এবং পশ্চিমতীরে যুদ্ধাপরাধ করছে। আর এই ক্যাম্প নির্মাণ করলে পরিস্থিতির তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাতজের পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে ওলমার্ট বলেন, এটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। আমি দুঃখিত। একবার ওই ক্যাম্পে প্রবেশ করলে ফিলিস্তিনিদের বের হতে দেয়া হবে না। শুধু অন্য দেশে যেতে দেয়া হবে। উল্লেখ্য, ইসরাইল কাতজ সামরিক বাহিনীকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন দক্ষিণ গাজার ধ্বংসাবশেষের ওপর ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’ নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়নে। শুরুতে সেখানে ৬ লাখ মানুষ থাকবেন। পরে ধীরে ধীরে পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে সেখানে ঢোকানো হবে। এরপর সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ বিষয়ে ওলমার্ট বলেন, যদি ফিলিস্তিনিদেরকে সত্যি এই ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’তে ঢোকানো হয়, তাহলে একে বলা যাবে জাতিগত নিধনের অংশ। যদিও এখনো তা ঘটেনি। তার মতে, লাখ লাখ মানুষের জন্য এমন একটি ক্যাম্প তৈরি করার যে কোনো প্রয়াসকে এভাবেই দেখা হবে।

তিনি বর্তমান ইসরাইলি অভিযানকে জাতিগত নিধন মনে করেন না। কারণ তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় যুদ্ধে বাঁচাতে নিরীহদের স্থানান্তর আইনসম্মত এবং ফিলিস্তিনিরা যে সব এলাকায় সামরিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে সেখানেও ফিরেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থন পাওয়া ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’ প্রকল্পের জন্য কাতজ যে এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরাতে চাইছেন, সেটি নিয়েই জোরালো বিরোধ চলছে। যা অস্ত্রবিরতি আলোচনার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ইসরাইলি মিডিয়া উল্লেখ করেছে।

ওলমার্ট বলেন, কয়েক মাসের আক্রোশপূর্ণ বক্তব্যের পর মন্ত্রীরা গাজা ‘পরিষ্কার’ করার ডাক দিয়েছে। সেখানে ইসরাইলি বসতি নির্মাণের প্রকল্প চালু রেখেছে। এরপর সরকার দাবি করছে এই ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’ ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য করা হবে। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, যখন তারা এমন একটি ক্যাম্প নির্মাণ করে যেখানে গাজার অর্ধেকের বেশি মানুষকে ‘পরিষ্কার’ করার পরিকল্পনা থাকে, তখন এর স্ট্র্যাটেজির স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এটি ফিলিস্তিনিদের বাঁচানোর জন্য নয়। এটি তাদের বিতাড়িত করা, ঠেলে দেয়া এবং ফেলে দেয়ার পরিকল্পনা। আমার পক্ষে অন্য কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

ইসরাইলের মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ও গবেষকরা এই প্রকল্পকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তারা সতর্ক করেছেন, এটা বাস্তবায়িত হলে ‘কিছু শর্তে এটি গণহত্যার অপরাধ হিসেবেও গণ্য হতে পারে’। অনেকে ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’কে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বলায় নাৎসী জার্মানির সঙ্গে তুলনা করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। ইসরাইলের হলোকাস্ট স্মারক কেন্দ্র ‘ইয়াদ ভাসেম’ এক সাংবাদিককে ‘হলোকাস্টের অর্থের গুরুতর ও অনুচিত বিকৃতি’ করার অভিযোগ করেছে। ওলমার্ট ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ইসরাইল শাসন করেন। তিনি গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলছিলেন যখন দখলকৃত পশ্চিম তীরের দুটি ফিলিস্তিনি পুরুষের দাফন সম্পন্ন হচ্ছিল। এর মধ্যে একজন আমেরিকান নাগরিক। তারা ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। ওলমার্ট বলেন, এই হত্যাকাণ্ডগুলি যুদ্ধাপরাধ। (এসব) ক্ষমা করা যায় না। গ্রহণযোগ্য নয়। বড় একটি দল সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও অপরাধমূলক পদ্ধতিতে এই কার্যক্রমগুলো সংগঠিত করছে।

যাদের ‘হিলটপ ইউথ’ বলা হয়, তারা ইসরাইলে সামান্য প্রান্তিক চরমপন্থি হিসেবে বিবেচিত। ওলমার্ট বলেন, তিনি তাদের কাজ বর্ণনা করতে ‘হিলটপ নৃশংসতা’ শব্দটিই পছন্দ করেন। এত বড় পরিসরে এত ধারাবাহিকভাবে তারা কাজ করতে পারে না, যদি তাদের জন্য কোনও সহায়তা ও সুরক্ষা না থাকে। যা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ থেকে আসে। যে কট্টরপন্থী মন্ত্রীরা গাজা ও পশ্চিম তীরে সহিংসতার পক্ষে, যেখানে তারা বসতি সম্প্রসারণ অনুমোদন দিয়ে ও আইন প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার জন্য অভ্যন্তরীণ শত্রু বলে উল্লেখ করেছেন, তাদেরকে ‘দেশের ভিতরের শত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। গাজার ভয়াবহ অবস্থা ও পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপনকারীদের অত্যাচার ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের কারণ। যা সবকিছুই অ্যান্টিসেমিটিজম হিসেবে লেখা যাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ওলমার্ট বলেন, আমেরিকায় ইসরাইলের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ দিন দিন বেড়েই চলছে। আমরা নিজেদের বলি ‘তারা অ্যান্টিসেমিট’। কিন্তু আমি মনে করি শুধু তাই নয়, অনেকেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে। কারণ তারা টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখছে তার জন্য। এটি যাদের জন্য বেদনাদায়ক, কিন্তু স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যারা বলছেন,  ‘তোমরা সবরকম সীমা লঙ্ঘন করেছো।’ ইসরাইলের মধ্যে মনোভাব পরিবর্তন শুরু হবে যখন আন্তর্জাতিক চাপের বোঝা তারা অনুভব করবে। তিনি বলছেন, দেশটিতে রাজনৈতিক বিরোধের অভাবে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ জরুরি। এছাড়া তিনি ইসরাইলি মিডিয়াকেও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার খবর প্রকাশে ব্যর্থতার জন্য সমালোচনা করেন। তিনি ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের হামলার পর হামাসের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযানকে সমর্থন করেন। কিন্তু এই বসন্তে ইসরাইল সরকার যখন ‘জনসমক্ষে এবং নির্মমভাবে’ যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তির আলোচনা ত্যাগ করে, তখন তিনি বুঝতে পেরেছেন দেশটি যুদ্ধাপরাধ করছে। তিনি বলেন, নিজেকে লজ্জিত ও হৃদয়ভাঙা মনে হয় যখন আত্মরক্ষার যুদ্ধ অন্য কিছুতে পরিণত হয়। আমি কী করতে পারি, এই অশুভ বিষয়গুলো স্বীকার করা ও সমালোচনা করা ছাড়া, এবং আন্তর্জাতিক মতামতকে জানানো যে ইসরাইলে অনেক অন্য মতামত ও কণ্ঠস্বর রয়েছে?

তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ ছিল অবহেলা ও অগ্রহণযোগ্য মৃত্যুর মাত্রা সহ্য করার মানসিকতা, নির্মমতার পরিকল্পিত প্রচার নয়। (কমান্ডাররা) আদেশ দিয়েছে? কখনও না। বরং তিনি বিশ্বাস করেন সামরিক বাহিনী দৃষ্টিচ্যুত হয়েছে যখন এমন কাজ সংঘটিত হয়েছিল যা অবশ্যই নিরীহ মানুষকে হত্যা করবে। এই কারণেই আমি এই সরকারকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করতে বাধ্য।
গাজার ধ্বংসাবশেষের পরও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা চালানো শেষ ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীরূপে, ওলমার্ট এখনও দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনা দেখেন। তিনি ফিলিস্তিনি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের আল-কিদওয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে এ লক্ষ্যে কাজ করছেন এবং এমনকি বিশ্বাস করেন গাজার যুদ্ধ শেষ ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়া সম্ভব, যদি নেতানিয়াহু সক্ষম বা ইচ্ছুক থাকতেন। তা বদলে ওলমার্ট হতবাক যে, নেতানিয়াহু যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তিনিই কিনা ডনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.