ট্রাম্পের ফের যুদ্ধ শুরুর হুমকি, সৌদি আরব কী চায়

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ফের শুরু হতে পারে। তবে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করেছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা পুনরায় শুরুর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানসহ ইরানের শীর্ষ নেতারা জনসমক্ষে বারবার আলোচনা পুনরায় শুরু করার পক্ষে মত দিয়েছেন। মঙ্গলবার ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি লিখেছেন, ‘পছন্দটা আমেরিকার- তারা কি কূটনীতিকে বেছে নেবে, না কি অন্য কারো যুদ্ধের ফাঁদে আটকে থাকবে?’ তার এ বক্তব্য স্পষ্টভাবে বোঝায় যে, ওয়াশিংটনের ইরান নীতিকে তিনি আমেরিকার নিজের সিদ্ধান্ত না বলে ইসরাইলের প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরছেন। আরাঘচির ভাষ্যমতে, মাত্র নয় সপ্তাহে পাঁচটি বৈঠকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে যতটা অগ্রগতি করেছি, তা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের চার বছরের ব্যর্থ পরমাণু আলোচনার চেয়েও বেশি।

এ বিষয়ে অনলাইন হারেৎজ পত্রিকা বিস্তারিত একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। তাতে আরও বলা হয়, আরাঘচি যখন এই প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, তিনি তখন সৌদি আরব সফরে ছিলেন। সেখানে তিনি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালেদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সৌদি মিডিয়ায় এই সফর ব্যাপকভাবে কভার করা হয়। সফর শেষে সৌদি আরবে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত আলি রেজা আনাইয়াতি বলেন, সৌদি নেতৃত্ব কূটনৈতিক চ্যানেল চালু রাখায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। এ সব ঘটনা এমন সময় ঘটছে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইরানকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার আঘাত হানার হুমকি দিচ্ছেন, যদি তারা আবার পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করে। কাতার, ওমান ও সৌদি আরব এই আলোচনাকে এগিয়ে নিতে সক্রিয় হয়েছে। কাতার, যেটি মার্কিন ঘাঁটি আল-উদেইদে ইরানের হামলাকে সমঝোতামূলক প্রতিশোধ হিসেবে মেনে নিয়েছিল, এখন পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর তত্ত্বাবধান পুনরায় চালু করতে চাইছে।

ইরান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তত্ত্বাবধায়ক এবং ক্যামেরা সরিয়ে নিয়েছে। ফলে বর্তমানে সাইটগুলোতে কোনো কার্যকর নজরদারি নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৪০৮ কেজি ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কী অবস্থা তার সুনির্দিষ্ট তথ্য কারও কাছে নেই। আলোচনার যেকোনো পুনরারম্ভের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে তত্ত্বাবধান ফেরানো, পরিদর্শন চালানো, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ইউরেনিয়াম খোঁজা অপরিহার্য। তবে ইরানে একটি নতুন আইন পাস হয়েছে, যাতে  আইএইএর সঙ্গে কোনো সহযোগিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তত্ত্বাবধানের অনুমতি শুধু ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’-এর অনুমোদনে দেয়া যাবে।
এ মাসের মধ্যেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ‘স্ন্যাপব্যাক ক্লজ’ চালু হতে পারে, যার ফলে ২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইরানের ওপর থেকে প্রত্যাহার করা নিষেধাজ্ঞাগুলো আবার ফিরিয়ে আনা হতে পারে। তবে আলোচনার অগ্রগতি ঘটলে এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে।

একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক হারেৎজকে বলেন, ট্রাম্প ও ইসরাইলের সামরিক হামলা ইরানের সব সমৃদ্ধকরণ সুবিধা ধ্বংস করতে পারেনি। অতএব, এখন খুব কঠোর তত্ত্বাবধান ও কূটনৈতিক চুক্তির বিকল্প নেই।

কাতার যখন আলোচনার পরিবেশ তৈরি করে, সৌদি আরব তা বাস্তবায়নে কূটনৈতিক কাঠামো ও গ্যারান্টির প্রস্তাব দিতে চায়। তবে তারা স্পষ্ট করেছে, ইরানের ওপর কোনো সামরিক আক্রমণ বরদাশত করবে না এবং তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতেও দেবে না। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা জোট বা নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়েও এখন আর মুখ খুলছে না। গাজা যুদ্ধের আগে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার শর্ত হিসেবে সৌদি আরব দুটি শর্ত দিয়েছিল- নিজের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে না দেয়া। এখন তারা বলছে, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনই হবে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের নতুন ভিত্তি।
সৌদি আরব সম্ভবত বুঝতে পারছে, ইরান আক্রমণে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ যেমন বিপন্ন হতে পারে, তেমনি নতুন কোনো পরমাণু চুক্তি হলে ইরান তেল রপ্তানিতে সৌদি আরবের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে।

ওপেক+ দেশগুলো উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি ব্লুমবার্গের অনুমান সঠিক হয়, তাহলে ভবিষ্যতে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৬০-৬৫ ডলার থেকে কমে ৪০ ডলারে নেমে আসতে পারে। এর ফলে সৌদি আরবের ২০৩০ ভিশন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হওয়ায় তারা প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে ৩.৩ মিলিয়ন ব্যারেল পর্যন্ত তেল বিক্রি করতে পেরেছে। নতুন চুক্তি হলে ইরান আরও তেল বাজারজাত করতে পারবে- যা সৌদি আরবের জন্য স্পষ্ট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.