এ কেমন হত্যাকাণ্ড? এ কেমন বীভৎসতা? by রাফসান গালিব
রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় এক ভাঙারি ব্যবসায়ীতে চাঁদার দাবিতে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার দিকের ঘটনা। ‘স্বাভাবিক চাঁদাবাজির ঘটনায় হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদনও হয়েছে। কিন্তু ঘটনার প্রায় দুই দিন পর আজকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পর কারও অস্বীকার করার সুযোগ নেই, এটি কোনো ‘স্বাভাবিক হত্যাকাণ্ড’ ছিল না। এটা ভয়ংকর এক মৃত্যু। বর্বরোচিত এক হত্যাকাণ্ড।
ঢাকার জনবহুল একটা এলাকায় এক রকম উল্লাস করে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে ওই ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছে। পিটিয়ে, কুপিয়ে, নির্যাতন করে পরনের কাপড় খুলে ফেলে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় ওই ব্যবসায়ীকে। এরপর বড় একটা পাথর দিয়ে একের পর এক আঘাত করে মাথা থেঁতলে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘাতক। এই দৃশ্য কি কোনোভাবে নেওয়া যায়? এ কেমন নৃশংসতা? এ কেমন বীভৎসতা?
এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে, লাল চাঁদ মিয়া ওরফে ওরফে মো. সোহাগ নামে ওই ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন ধরে রজনী ঘোষ লেনে ভাঙারি ব্যবসা করতেন। ভাঙারি ব্যবসার সঙ্গে পুরোনো বৈদ্যুতিক কেবল কেনাবেচার ব্যবসা করতেন তিনি। ওই তার বেচাকেনার সিন্ডিকেট নিয়ে বিরোধ এবং চাঁদার দাবি জানিয়ে আরেকটা গ্রুপ কয়েক মাস ধরে সোহাগকে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল। এর প্রেক্ষিতে বুধবার সন্ধ্যায় সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সোহাগ ও তাঁকে হত্যাকারী পক্ষ সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
হত্যাকারীদের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত মাহমুদুল হাসান মহিন সম্পর্কে জানা যাচ্ছে, তিনি যুবদলের চকবাজার থানার সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে মিটফোর্ড হাসপাতালের ফুটপাত ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি হাসপাতালের কর্মচারী নিয়োগেও মোটা অঙ্কের ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। লালবাগ থানা ছাত্রদলের সদস্যসচিব রাব্বিও স্বীকার করেছেন, তিনি মহিনকে চিনেন। মঈন যুবদলের সক্রিয় কর্মী। (দৈনিক যুগান্তর)
সোহাগকে শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা। সোহাগের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও লাশের ওপর চলতে থাকে নৃশংসতা। রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে ফেলে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে চলে ভয়াবহ উন্মত্ত উল্লাস।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের সময় সেখানে অসংখ্য মানুষ ছিল। এত মানুষের সামনে পাথর দিয়ে একের পর এক আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে সোহাগকে। তাঁকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। স্থানীয়রা বলছেন, মঈন যুবদল নেতা। এলাকায় সে প্রভাবশালী। তাঁর ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। যদিও হত্যাকাণ্ডের পর অভিযুক্ত মঈনসহ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যেভাবে মানুষ বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বৈরাচারের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীর বিরুদ্ধে, গুলির মুখে দাঁড়িয়ে যেতে ভয় করেনি; এক বছর পর সেই মানুষই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ‘উপভোগ’ করল! জুলাই নাকি মানুষকে সাহসী করেছে, মানুষকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে, অপশক্তির সামনে মাথা না করতে শিখিয়েছে—এটিই কি তার নমুনা!
এ রকম ভয়ংকর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমাদের পুরান ঢাকার দরজি বিশ্বজিতের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা কীভাবে তাঁকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল, সেই দৃশ্য এখনো আমরা ভুলতে পারি না। যুবদলের এই সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগের কথাও কি আমরা কখনো ভুলতে পারব?
জুলাই গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে সেই ট্রমাই মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে এমন হত্যাকাণ্ড আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? এই মানসিক বিপর্যস্ততা নিয়ে এই জাতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
খুলনার দৌলতপুরে আজকে শুক্রবার আরেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সেখানে থানা যুবদলের সাবেক এক নেতাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত সাবেক যুবদল নেতা কয়েক মাস আগে নিজেই রামদা হাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সেই সংঘর্ষের ঘটনার পর যুবদল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আজকে তিনি নিজেই খুন হলেন। স্থানীয় পুলিশ প্রাথমিকভাবে বলছে, এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা চলছে।
আজকে আরেকটি হত্যাকাণ্ড আমাদের হতবাক করে দেয়। চাঁদপুরে জুমার নামাজের পর এক ইমাম ও খতিবকে মসজিদের ভেতরেই কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছেন এক ব্যক্তি। খতিব সাহেব স্থানীয়ভাবে স্বনামধন্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ওই ঘাতক ব্যক্তির নাকি ইমাম সাহেবের জুমার খুতবা পছন্দ না। এ জন্য আজকে আগ থেকে খতিব সাহেবকে হত্যার উদ্দেশে চাপাতি নিয়ে মসজিদে ঢুকেছিলেন ওই ব্যক্তি। তাঁর দাবি, ইমাম সাহেব ইসলামের নবী (সা.)-কে অবহেলা করে কথা বলেছেন।
কাউকে ‘শাতিম’ আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের আহ্বান আমরা কয়েক মাস আগে দেখেছি। যেখানে রাষ্ট্রের আইন ও বিচারকে তোয়াক্কাই করা হয়নি। তার জ্বলন্ত নমুনা আজকে চাঁদপুরে দেখা গেল। যত্রতত্র যেভাবে শাতিম আখ্যা দিয়ে মানুষকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে, মানুষের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে, তা আমাদের ধর্মীয় সমাজের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্নই করছে না, ভবিষ্যতের জন্য বড় বিপজ্জনক পরিস্থিতিও কি ডেকে আনছে না? সরকার কি এসব ব্যাপারে চুপই থাকবে?
একটার পর একটা নৃশংস ঘটনা ঘটছে। বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ উঠছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার কী করছে? কোনো ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিক ছুটে যেতে প্রশাসন কোথায়? থানা-পুলিশ কোথায়? সরকারের ব্যক্তিবর্গ কোথায়? এক বছরেও কেন দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছেন না তারা? পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি কেন সবচেয়ে ‘গুরুত্বহীন’ করে ফেলা হলো? দেশের মানুষকে এইভাবে নিরাপত্তাহীনতার মধ্য ছেড়ে দিয়ে কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারা? রাজধানীতে বসে শুধু ‘হুঁশিয়ারি বার্তা’ দিয়ে কি প্রশাসন চালানো যায়?
বিএনপিই কেন বা শুধু বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে নিজের সাংগঠনিক দায়িত্ব শেষ করছে? দলীয় বিরোধে চট্টগ্রামের শুধু এক থানায় রাউজানেই ১৫ জনের বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেছে। উপজেলাটিতে ঢাকা থেকে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি দল গিয়েছিল কি?
কতভাবেই দলীয় শৃঙ্খলার পদক্ষেপ নেওয়া যায়। শুধু দূর থেকে সতর্কবাণী দিয়ে বা বহিষ্কার করে কি দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব? সাংগঠনিক দক্ষতা বলতে যে একটি বিষয় আছে, সেটি যে একেবারেই দলটির নেতৃত্ববৃন্দের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না, তা কি তারা নিজেরা বুঝতে পারছেন?
দেশজুড়ে দলটির অপকর্মের শেষ নেই। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে আগামী নির্বাচনে বিএনপিই ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে বলে অধিকাংশ মানুষ মনে করে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগেই এও আশঙ্কা করছে এক ফ্যাসিবাদী শাসনের পর আরেক ফ্যাসিবাদী শাসনের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছে কি দেশ? এমন আশঙ্কা কীভাবে দূর করবে বিএনপি? জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর যে নতুন রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা কি অধরাই থেকে যাবে?
* রাফসান গালিব, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
![]() |
| গত বুধবার বিকেলে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে রাস্তার ওপর ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে নৃশংসভাবে হত্যার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া |

No comments