অগ্নিঝরা জুলাই: এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি নাঈমার বাবা-মা by ফাহিমা আক্তার সুমি
শহীদ নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহার মানবজমিনকে বলেন, সন্তান মারা যাওয়ার ট্রমা থেকে এখনো বের হতে পারছি না। সারাক্ষণ চোখের পানি ঝরতে থাকে। ১৯শে জুলাই বিকালের দিকে নাঈমা চারতলার বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়। বিকাল ৪টার দিকে নাঈমা তার রুমে বসে ‘বয়কট ছাত্রলীগ’, ‘কোটা সংস্কার চাই’ সহ নানা স্লোগানে রঙিন কালিতে প্রতিবাদী পোস্টার আঁকছিল। আঁকাআঁকি থেকে উঠে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মু পিৎজা বানাবো। ফ্রিজে চিকেন আছে নাকি? এরপর বলে, ‘বেলকনিতে কাপড়গুলো শুকিয়েছে আমি নিয়ে আসি’- এই কথা বলে বারান্দায় যায়। সে সময় উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে পুলিশ গুলি করতে করতে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় ছাত্ররা আমাদের বাসার নিচে অবস্থান করছিল। তখন বাসার ডানে-বামে যে বাসাগুলো রয়েছে সেখানের সব পরিবারের লোকজন বারান্দায়, ছাদের উপরে গিয়ে দেখছিল। ওই সময় আমার মেয়েটা বারান্দায় দাঁড়ানো ছিল। আমি পেছনে ছিলাম এক-দুই মিনিটের জন্য পাশে থাকা রান্নাঘরে যাই। তখনই আবার রান্নাঘর থেকে ছুটে যাই মেয়েটাকে আনতে বারান্দার দিকে। গিয়ে দেখি আমার মেয়ে পড়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, ওইদিন আমিও মেয়েটার সঙ্গে চলে যেতে পারতাম। আমি তার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, গুলির কোনো শব্দ পাইনি। মেয়েকে যে গুলিটা করা হয়েছে সেটি ছিল স্নাইপারের গুলি। ওর মাথার ক্ষত কতোটুকু গভীর হয়েছিল, সেটি এখনো চোখে ভাসে। মাথার মগজ বেরিয়ে গুঁড়ি হয়ে গিয়েছিল। আমার বাসা-বারান্দা রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ছাত্ররা নিচ থেকে দেখেছিল গুলি লেগেছে কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি।
উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে একটি বাসায় ভাড়া থাকেন নাঈমার পরিবার। তিন ভাই-বোন তাদের মাকে নিয়ে থাকতেন। বাবা পল্লি চিকিৎসক। তিনি গ্রাম থেকে আসা-যাওয়া করেন। নাঈমার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে চিকিৎসক হবেন। আইনুন নাহার বলেন, ২০২২ সালে ঘর-বাড়ি ফেলে রেখে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় আসি। অনেক স্বপ্ন ছিল- তাদের বড় করবো, মানুষের মতো মানুষ করবো। ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করাবো। নাঈমা অত্যন্ত মেধাবী ছিল। শুরু থেকে ওর প্রথম হওয়া কেউ ঠেকাতে পারতো না। নাঈমার জন্ম ২৫শে জুলাই ও মারা গেল ১৯শে জুলাই। কীভাবে যে আমাদের দিন যায়, কী হচ্ছে- একমাত্র আমরাই জানি। মেয়েটার জন্য ভালো-মন্দ রান্না করতাম। সব সময় ভালো-মন্দ খেতে চাইতো। জন্মদিন এলে ওর বড় বোন ওকে না জানিয়ে গিফট কিনতো, সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। আজ আর আমাদের কারও মনে খুশি নেই। আমাদের হাসি-খুশি সব হারিয়ে গেছে। খুব সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতো। আমি এবং ওদের বাবা দু’জনই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। নাঈমা সব সময় বলতো- আমার বাবা-মা আমার গর্ব। আমিও বড় হয়ে ডাক্তার হবো।
তিনি আরও বলেন, আমার খুব ইচ্ছা ছিল একবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু সেখানেও বৈষম্য। অনেকে তার সঙ্গে দেখা করেছে কিন্তু আমার একবারের জন্যও দেখা হয়নি। আমার মেয়ে তো আন্দোলন নিয়ে অনেক কিছু করেছে। সে সব সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাক্টিভ থাকতো। ১৯শে জুলাই আন্দোলনকারীদের জন্য খাবার, স্যালাইন কোথায় দিচ্ছে সেটি গ্রুপে গ্রুপে শেয়ার করতো। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দুইটা লোক আমার বারান্দার দিকে বন্দুক ধরে আছে। তার মধ্যে একটা লোক নিচের দিকে গুলি করছে, আরেকটা লোক আমার নাঈমার দিকে টার্গেট করে গুলি করেছে। তিনি বলেন, আমার কষ্ট তো থামবে না। তবে একদিক থেকে আমি গর্বিত যে, আমার মেয়ে শহীদ হয়েছে, আমি একজন শহীদের মা। কিন্তু আমি নিজেকে লজ্জিতও মনে করি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। একজন মায়ের পাশে থেকেও একজন সন্তানের নিরাপত্তা ছিল না। বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে যদি গুলি খেতে হয়, তাহলে আমাদের নিরাপত্তাটা কোথায়? সবার কাছে আমার এই একটাই প্রশ্ন। এটার বিচারটা করা উচিত। যেন ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট তৈরি না হয়।
শহীদ নাঈমার বাবা গোলাম মোস্তফা বলেন, সন্তান হারানো কোনো বাবাই ভালো থাকতে পারে না। আজ এক বছর হয়ে এলো, আমার সন্তান আমাকে বাবা বলে ডাকে না। সেই ১৯শে জুলাই থেকে আমরা পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার বাচ্চাকে টার্গেট করে গুলিটা করা হয়েছে। মাথার বাম দিকে গুলিটা ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। চোখের সামনের এই দৃশ্য কি কখনো ভুলে থাকা যায়। ওর মা দেখে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায়। আমাদের এখন মানসিক চিকিৎসক দেখাতে হচ্ছে। মেয়েটার মেধা ভালো দেখে তাকে মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি করা হয়। এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। আমার দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে নাঈমা ছিল মেজো। আমিতো আমার মেয়েকে আর কোনোদিন পাবো না। এই জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। এটি খুব ধীরগতিতে চলছে, এই কার্যক্রমটা আরও ত্বরান্বিত হতে হবে। যারা জীবন দিয়েছে তাদের হত্যার বিচার যেন সুষ্ঠুু এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হয়। সুষ্ঠু বিচার হলে এটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়ে থাকবে আজীবন এবং সমস্ত রাজনীতিবিদরা এখান থেকে শিক্ষা নেবে। বিচার সঠিক এবং স্বচ্ছ হতে হবে, কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়। যারা দোষী শুধুমাত্র তাদের বিচারটাই যেন হয়। তিনি বলেন, আমার মেয়ে যে স্বপ্ন বা উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিল সেটি পূরণ হয়েছে। শুধু আমার মেয়ে নয়, সমস্ত শহীদরা যে উদ্দেশ্য-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। তাদের রক্তের বিনিময়ে সুন্দর একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই। যে আশা নিয়ে জুলাই আন্দোলন করেছিল, ফ্যাসিবাদমুক্ত করেছিল সেই রক্ত যেন বৃথা না যায়। তাদের স্বপ্ন যেন পূরণ হয়। এই বাংলায় আমরা কোনো বৈষম্য চাই না। সবার জন্য হোক এই দেশটা। যেই ক্ষমতায় আসুক যেন বৈষম্যমুক্ত, শোষণমুক্ত এবং সবার জন্য যেন এই আবাসনটা একটা নিরাপদ ভূমিতে রূপান্তর হয়।

No comments