নবাবগঞ্জে আবাসন প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ রিমনের হাতে! by ইমরান হোসেন সুজন

রিমন রহমান। সরকারি কোনো কর্মকর্তা না হয়েও দায়িত্ব পেয়েছেন ঢাকার নবাবগঞ্জের চর মাহতাবপুর (পাড়াগ্রাম) এলাকায় আবাসন প্রকল্প-১ ও চরকোন্ডা মুজিবনগর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এ দুইটি আবাসন প্রকল্পের। প্রকল্পের বাসিন্দাদের কাছে তিনি ‘রিমন স্যার’ হিসেবেই পরিচিত। স্থানীয়দের জানান, আবাসন প্রকল্পে কে থাকবে আর কে থাকবে না তা নির্ধারণ করে এ রিমন ও ভূমি অফিসের কর্মচারী নাসির। প্রকল্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমিহীনদের জন্য মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে চর মাহতাবপুর (পাড়াগ্রাম) এলাকায় আবাসন প্রকল্প-১ এ ১৪০টি ঘর ও চরকোন্ডা মুজিবনগর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এ ১৯৯টি ঘর নির্মাণ করা হয়। জমিসহ ঘর পেয়ে অনেকটা খুশি ছিলেন ভূমিহীনরা। তবে আয়ের পথ না থাকায় সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরিকল্পনা ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করায় দেখা দেয় নানা সমস্যা। এত সমস্যা নিয়ে বিপাকে পড়েন  ঘর বরাদ্দ পাওয়া লোকজন। বিশেষ করে আয়ের পথ না থাকায় বাধ্য হয়ে কাজের সন্ধানে ঘর তালা দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যায় তারা। এ সুযোগে কোনো ঘর ১০/১৫ দিন বন্ধ থাকলেই তালা ভেঙে দখল করে নেন রিমন গংরা। স্থানীয়দের অভিযোগ পরবর্তীতে সে ঘরগুলো নিজেদের লোকদের বরাদ্দ দেন রিমন।

স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, সংশ্লিট অফিস সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে শিক্ষা, চিকিৎসা, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ, মাদক ও নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত আবাসন প্রকল্প দুইটি। দীর্ঘদিনও সরকারি কোনো কর্মকর্তা না আসায় ঘর বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রেও নিজের কর্তৃত্ব জাহির করেন রিমন। উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মচারী নাসির ও স্থানীয় কথিত যুবদল নেতা সুমনকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন নতুন  সিন্ডিকেট। তবে আবাসনের কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেন না রিমন। আবাসনের সব কিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন।

চরকোন্ডা মুজিবনগর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর বাসিন্দা হরিপদ পাল বলেন, পাড়াগ্রামের রিমন ও স্থানীয় সুমন এরাই প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করে। কে ঘরে থাকবে, কে থাকবে না সব কিছুই তারা করেন। তারা একটা গ্রুপ তৈরি করছে, তারা তালা ভেঙে ভেঙে মানুষজনকে বের করে দেয় আবার ঢুকায়। টাকার বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ হওয়ার ঘটনা সবাই জানে কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় নাই।
একই প্রকল্পের বাসিন্দা সাগির আহমেদ বলেন, সরকার আমাকে ঘর দিছে, আমি না থাকলে সরকার আমাদের বের করে দিবে। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনেও ১০/১২ দিন লাগাতার না থাকলেই ওরা ঘর প্রথমে তালা দেয়, পরবর্তীতে তা অন্যজনকে দিয়ে দেয়। আর এ সিন্ডিকেটের মূলহোতা হলো পাড়াগ্রামের রিমন। তাকে সহযোগিতা করেন উপজেলা ভূমি অফিসের নাসির ও এলাকার কিছু পাতি নেতা।

নজরুল নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, প্রকল্পের বাসিন্দারা খুব কষ্টে আছে। এতদিন হয়ে গেল আমরা কোনো মিটার পাচ্ছি না, গরমে খুব কষ্ট করতে হয়। এ ছাড়া একটা কবরস্থানও নেই, কেউ মারা গেলে মাটি দিতে পারি না। প্রথম থেকেই রিমন ভাই প্রকল্প দুইটির দায়িত্বে আছে। শুধু ঘর তালা দিয়ে অন্যজনকে বুঝিয়ে দেয়ার সময় তাকে দেখি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার এক আত্মীয়ের জন্য একটা ঘরের জন্য ডিসি স্যার ও এসিল্যান্ড অফিসে গিয়েছিলাম। তারা বলেছিল কোনো ঘর নাই আপাতত, তাহলে রিমন ভাই ঘর কীভাবে পায়। আসলে সব টাকার খেলা।

আশুতোষ পাল বলেন, চরকোন্ডা মুজিবনগর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এ একপাশই আছে হিন্দুদের জন্য। এখানে সব হিন্দুদের ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যাতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে আনন্দ উৎসব পালন করতে পারি। কিন্তু এখন রিমন কয়েকজন মুসলমান পরিবারকে সেখানে ঘর বরাদ্দ দিয়েছে। এতে যেমন ধর্মীয় উৎসব পালনে আমরা বিব্রত হই, তেমনি যিনি ঘর পেয়েছেন তিনিও অস্বস্তিতে পড়েন। তিনি আরও বলেন, যদি চিকিৎসার জন্য আপনি ১৫দিন বাইরে থাকেন, তাহলে ফিরে এসে ঘর পাবেন কিনা সন্দেহ আছে। রিমন স্যাররা সব তালা দিয়ে দখল করে নিবে।

চর মাহতাবপুর (পাড়াগ্রাম) এলাকায় আবাসন প্রকল্প-১ এর সভাপতি নুর ইসলাম বলেন, অফিসের বাইরেও কয়েকজন দালাল আছে, যারা মন মতো লোকজনকে ঘর বরাদ্দ দেয়। এ প্রকল্পে ১৪০ ঘরের মধ্যে এখন ৭০টা মতো পুরাতন পরিবার আছে। আর সবগুলো হাত বদল হয়েছে। রিমনের নেতৃত্বে এসব হয়। আমিও শুনেছি টাকার বিনিময়ে এসব ঘর হাতবদল হয়েছে। এ ছাড়া আবাসন প্রকল্পে মাদকের উপদ্রব বেড়ে গেছে। পানিসহ নানা সমস্যা কিন্তু সমাধানে কেউ এগিয়ে আসে না। এ বিষয়ে অভিযুক্ত রিমন রহমান জানান, আমাকে ভূমি অফিস থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আমি কাউকে ঘর থেকে বের করে দেয় নাই। এসিল্যান্ড অফিসের অনুমতি ছাড়া কাউকে নতুন করে ঘর দেয়ার সুযোগ নেই। যা করি অফিসের অনুমতি নিয়েই করি। অনেকে আছে মাসের পর মাস ঘরে থাকে না, কই আমি তো তাদের ঘরে তালা দেই না। আর টাকার বিনিময়ে ঘর দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আসলে একটি চক্র আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আবাসন নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যেন তারা মাদক ব্যবসাসহ অপকর্ম করতে পারেন।

নবাবগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসিফ রহমান বলেন, আবাসন প্রকল্পগুলো আমরা  দেখভাল করি। স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় সব কাজ করা হয়। রিমনের ব্যাপারে আমি অবগত নয়। সেখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো তাদের কি সমস্যা আছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.