পাক-ভারত সংঘাতে কারা এগিয়ে, চীন নাকি পশ্চিমারা?
সাউথচায়না মর্নিং পোস্টের বিশ্লেষক সিনং হিয়োন চিও তার ‘চায়নিজ উইপনস পাওয়ার পাকিস্তান ইন কাশ্মীর কনফ্লিক্ট, বাট ডাউটস রিমেইন’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লিখেছেন, গত সপ্তাহের বুধবার পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের বেশ কিছু স্থানে হামলা চালায় ভারত। যেই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে অপারেশন সিঁদুর। ভারতের এই অভিযানের পরই পারমাণবিক শক্তিধর দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। ২২ এপ্রিল ভারত-অধিকৃত পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলার জেরে পাকিস্তানে হামলা চালায় দিল্লি। পেহেলগামের পাহাড়ী মনোরম উপত্যকার ওই হামলায় মোট ২৬ জন নিহত হন। যাদের বেশির ভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ের না। এরপর গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে নয়াদিল্লি দাবি করে হামলায় জড়িত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত। যার জবাবে পাকিস্তানে নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে তারা। এসব হামলায় ফ্রান্সের তৈরি অত্যাধুনিক রাফাল নামের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভারত। এছাড়া দূর এবং মাঝারি পাল্লার এএএসএম হামার নামের ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহারের কথা জানিয়েছে দেশটি। পাকিস্তান দাবি করেছে তারা ভারতের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করেছে। যার মধ্যে রাফাল ছিল তিনটি। যদিও ইসলামাবাদের এই দাবির বিষয়ে কিছুই জানায়নি দিল্লি। তবে সিএনএন জানিয়েছে, ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে, কমপক্ষে ভারতের একটি রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তান। অন্যদিকে রয়টার্স জানিয়েছে, তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ দুই কর্মকর্তা বলেছেন, পাকিস্তান চীনের জে-১০সি যুদ্ধবিমান দিয়ে ভারতের দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।
১৯৪৭ সালের পর থেকে কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে ভারত ও পাস্তিান। এরমধ্যে হিমালয় অঞ্চলে দুই দেশের সঙ্গে কিছু অংশের দখলে রয়েছে চীন। শুরু থেকেই কাশ্মীরের দুটি অংশ ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর যেই রেখার মাধ্যমে দুই অংশ বিভক্ত হয়েছে তার নাম লাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা। কাশ্মীরের আঞ্চলিক বিরোধ দিল্লি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে একটি প্রধান উত্তেজনার বিষয় হিসেবে রয়েছে। যা উভয় পক্ষের সামরিক দ্বন্দ্বকে আরও উসকে দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রাগারের উন্নয়ন এবং সীমান্তের কাছে অবিরাম গোলাগুলি। পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রয়েছে চীনের। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) কর্তৃক পরিচালিত বিশ্বব্যাপী অস্ত্র স্থানান্তরের তথ্যানুসারে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট অস্ত্র আমদানির ৮১ শতাংশই চীন থেকে করেছে পাকিস্তান। বিপরীতে ভারতও চীনের কাছ থেকে কিছু যুদ্ধাস্ত্র আমদানি করে। তবে দিল্লির অস্ত্রদাতা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফ্রান্স ও রাশিয়া। গত চার বছরে যথাক্রমে এ দুই দেশ থেকে ৩৩ ও ৩৬ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করেছে ভারত। আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ করেছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। সুতরাং ভারত-পাকিস্তান সংঘাত মানেই চীন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের সমরাস্ত্রের লড়াই।
চীনের তৈরি অস্ত্রের মধ্যে পাকিস্তানের কাছে সবচেয়ে বেশি রয়েছে যুদ্ধবিমান। সর্বশেষ সংঘাতে পাকিস্তানের ব্যবহৃত জে-১০সি এবং জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান চীনের তৈরি। বুধবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার পার্লামেন্টে দাবি করেছেন, জে-১০সি বিমান দিয়েই ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। যদি পাকিস্তানের দাবি নিশ্চিতভাবে সত্য হয় তাহলে, আকাশযুদ্ধে চীনা যুদ্ধবিমানের এটিই হবে প্রথম সফলতা। পক্ষান্তরে ফরাসী রাফাল যুদ্ধবিমানের প্রথম ক্ষতি। জে-১০সি ৪ দশমিক ৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে পরিচিত। যা দিয়ে আকাশ থেকে আকাশ যুদ্ধে দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা যায়। চীন ব্যতিত এই সিরিজের যুদ্ধবিমান একমাত্র পাকিস্তানের বিমারুরাই পরিচালনা করতে পারে। ২০২০ সালে চীন থেকে মোট ৩৬টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান আমদানি করার চুক্তি করেছে পাকিস্তান। যা ২৫০ পিএল-১৫ই ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম। বর্তমানে বিশেষ ওই যুদ্ধবিমানের ২০টি হাতে পেয়েছে পাকিস্তানের বিমান বাহিনী।
শুক্রবার ভারত দাবি করেছে যে, তারা পাকিস্তানের জেএফ-১৭ সিরিজের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যদিও ইসলামাবাদ এই দাবি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জানিয়েছে ভারত কোনো যুদ্ধবিমানই ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়নি। জেএফ-১৭ হলো ৪ জেনারেশনের একটি যুদ্ধবিমান। যেটি পাকিস্তান ও চীন যৌধভাবে তৈরি করেছে। এই যুদ্ধবিমানও পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম।
এসআইপিআরআই- এর এক জ্যেষ্ঠ গবেষক সিমন ওয়েজম্যান বলেছেন, সংখ্যা এবং অনেক ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিতেও এগিয়ে আছে ভারত। তবে, সীমিত এই সংঘাতের ফলাফল পাকিস্তানের পক্ষে যেতে পারে। কারণ এখানে সংখ্যার গুরুত্ব কম। এছাড়া এখানে ভারতের প্রযুক্তিগত সুবিধার পূর্ণ ব্যবহারের সম্ভাবনাও বেশি থাকে না। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি আমরা দেখলাম চীনের সমরাস্ত্র পাকিস্তানের হাতে বেশ কার্যকর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পশ্চিমা এবং রাশিয়ার অস্ত্রের তুলনায়ও চীনের অস্ত্র বেশ শক্তিশালী। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, গত দুই দশকে চীন সমরাস্ত্র তৈরিতে অনেক অনেক এগিয়ে গেছে। ওয়েজম্যান যোগ করেছেন, যদিও চূড়ান্ত ফলাফল দেয়ার জন্য আরও তথ্যের প্রয়োজন। কেননা চীনের অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে এখনও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এটাই প্রথম, যেখানে চূড়ান্ত যুদ্ধক্ষেত্রে চীনের এসব আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহারের কথা জানা গেছে।
সিএনএনের রিপোর্ট: কেন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো ভারত-পাকিস্তান
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য পান যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এরপরই ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু করতে উৎসাহিত করেন। এ খবর দিয়ে অনলাইন সিএনএন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও, হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ সুসি উইলিসসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা শুক্রবার সকালে যখন ভারত-পাকিস্তানের তীব্র উত্তেজনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে যায় উদ্বেগজনক গোয়েন্দা তথ্য। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ কথা বলেছেন সিএনএনকে। কি জাতীয় তথ্য পেয়েছিলেন মার্কিন কর্মকর্তারা, স্পর্শকাতরতার কারণে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান ওই কর্মকর্তারা। তবে তারা বলেছেন, তিনজন কর্মকর্তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে- যুক্তরাষ্ট্রের এক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা বাড়ানো উচিত। ফলে নিজে থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন জেডি ভ্যান্স। এ পরিকল্পনা নিয়ে প্রথমে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে অবহিত করেন জেডি ভ্যান্স। তারপর শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে মোদিকে ফোন করে তিনি কথা বলেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পরিষ্কার করেন যে, হোয়াইট হাউস বিশ্বাস করছে যে উত্তেজনা উচ্চমাত্রায় নাটকীয় মোড় নিতে যাচ্ছে। ফলে মোদিকে সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য উৎসাহিত করেন জেডি ভ্যান্স। একই সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের পথ বেছে নিতে বলেন। এ বিষয়ে এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার বিস্তারিত তথ্য নেই। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী এই দুই দেশের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছে না। তাদেরকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনা দরকার। এ অবস্থায় মোদিকে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার ওপর জোর দেন জেডি ভ্যান্স। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অনুধাবন করতে পেয়েছে- তাতে রাজি হবে পাকিস্তান। তবে এ বিষয়ে ওই কর্মকর্তারা আর কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি। এরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সহ তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রাতভর ভারত ও পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে আলোচনা চালিয়ে যান। মঙ্গলবার থেকে একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছার সাধারণ ধারণা দিয়ে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছিলেন মার্কো রুবিও। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এ বিষয়টি কীভাবে করা হবে সে বিষয় ছেড়ে দিয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের ওপর। মার্কো রুবিও ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে যখন ফোনে কথা বলেছেন তখন সে সম্পর্কে যেসব কর্মকর্তা ভালোভাবে জানেন তাদের একজন বলেছেন- এ সপ্তাহে উত্তেজনা কমিয়ে আনার যথেষ্ট প্রচেষ্টা ছিল। বিশেষ করে এক সময় দেখা যায় উভয় পক্ষ আর আলোচনা করছে না। এ সপ্তাহে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তাতে ভারত ও পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনাকে উৎসাহিত করা হয়। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে উত্তেজনা হ্রাসের একটি পথ বের করতে বলা হয়। তবে যুদ্ধবিরতির খসড়া প্রণয়নে জড়িত নয় ট্রাম্প প্রশাসন। এমন অবস্থায় জটিল এক মুহূর্তে মোদিকে ফোন করেন জেডি ভ্যান্স। তিনি এর আগে গত মাসে ভারত সফর করেছেন এবং মোদির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। এর ফলে ট্রাম্পের কর্মকর্তারা মনে করেন মোদির সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণে তার ফোনকল কাজে দেবে। ফলে কয়েকদিন আগে যে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে বলেছিলেন এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করার নেই, তিনিই শেষ পর্যন্ত মোদিকে ফোন করেন। এর ফলে শনিবার তীব্র লড়াইয়ের পর উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছে।

No comments