মোদির নতুন চাল by অজয় আশীর্বাদ মহাপ্রশস্ত
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া মোদির জন্য বড় ধাক্কা। এক দশকের বেশি সময় ধরে যে একচ্ছত্র ক্ষমতা তিনি ভোগ করছিলেন, এই নির্বাচন তাকে হঠাৎ করেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় মোদির সামনে মূল চ্যালেঞ্জ, কীভাবে এই পরাজয়ের অভিঘাত ধুয়েমুছে আবারও নিজেকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে তুলে ধরা যায়।
এর জবাবে তিনি বেছে নেন পুরোনো পথ—জনগণকে জীবনের মৌলিক সমস্যা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার রাজনীতি। মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানহীনতা, অর্থনীতির অস্থিরতা কিংবা আদমশুমারির মতো মৌলিক কর্তব্য—সবই চাপা পড়ে যায় ‘দেশদ্রোহীদের’ বিরুদ্ধে একাত্মতার ডাক, বা ‘হিন্দু-মুসলিম’ বিভাজনের রণহুংকারে।
২০২৪ সালে আয়োজিত অযোধ্যার রামমন্দিরের উদ্বোধনকেও মোদি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু তার ফল হয় উল্টো। বিজেপি অযোধ্যার কেন্দ্র ফৈজাবাদে হেরে যায়। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি বিজেপিকে ছাপিয়ে যায়। মহারাষ্ট্রেও বিজেপির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে।
এই পটভূমিতে, মোদি তৎপর হন নিজের ভাবমূর্তি পুনর্গঠনে। শুরু হয় এক বিস্তৃত প্রচারাভিযান। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল, পরাজয় ও হতাশার স্মৃতি ধুয়ে ফেলা। সংসদে নিজের প্রথম ভাষণেই তিনি বলেন, যাঁরা তাঁর সমালোচনা করছেন, তাঁরা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এর পর থেকে প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি একই বার্তা দেন; মোদি মানেই দেশ, দেশ মানেই মোদি।
এই বার্তা ছড়াতে গিয়ে বিজেপি তিনটি কৌশল নেয়। প্রথমত, তারা নিজেদের ভোটে হারার কারণ হিসেবে ‘অপপ্রচার’ আর ‘ভ্রান্ত তথ্য’কে দোষারোপ করে।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকারের শক্ত অবস্থানকে নতুন করে জোর দিয়ে তুলে ধরে। মানে, শক্ত হাতে দেশ চালানোই মোদির একমাত্র পথ।
তৃতীয়ত, হেরে যাওয়া রাজ্যগুলোয় বিজেপি জোরালোভাবে ফিরে আসার চেষ্টা চালায়। হরিয়ানায় বিরোধীদের ঘায়েল করে আবার ক্ষমতায় আসে। মহারাষ্ট্রে নজিরবিহীন জয় পায় এবং জম্মু অঞ্চলেও ভালো ফল পায়।
এদিকে উত্তর প্রদেশে লোকসভা নির্বাচনের পরপরই হিন্দু-মুসলিম বিভাজনমূলক বক্তব্য ও ঘটনার পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে যায়। এমনকি হোলি-দীপাবলির মতো উৎসবগুলোও ব্যবহার করা হয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতি ছড়াতে। রাজ্য উপনির্বাচনে মুসলিম ভোটারদের বাধা দেওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ আবারও নিজেকে ‘হিন্দুত্বের কঠোর রূপ’ হিসেবে তুলে ধরেন।
এরপর মোদির আরও একটি কৌশল নজরে আসে—আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন। লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা বলেছিলেন, তাদের আর আরএসএসের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। এর জবাবে সংঘ পরিবার লোকসভায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। অবশেষে মোদি নিজেই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাগপুরে আরএসএস সদর দপ্তরে যান, নিজের আনুগত্য জানান। এটি ছিল এক প্রতীকী পদক্ষেপ। তিনি দেখাতে চাইলেন যে সংঘ পরিবার ও বিজেপি এখন আবার এক সুরে কথা বলছে।
আর ঠিক সেই সময়েই আসে ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল। এটি সংসদে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে পাস হয়। মোদি সরকারের ১১ বছরের শাসনে এটা বিরল ব্যপার। এর আগে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল কিংবা তিন তালাক আইন কার্যকর করার সময় এমন আলোচনা হয়নি।
বিলটি মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থী হলেও বিজেপি এটিকে ‘মুসলিমদের কল্যাণের আইন’ হিসেবে তুলে ধরে। বিজেপির একমাত্র মুসলিম সাংসদ গুলাম আলি সংসদে বক্তব্য রাখলেও বিলটির পক্ষে নয়, বরং কংগ্রেসের বিরোধিতা করেই সময় কাটান।
মোদির লক্ষ্য ছিল অন্য জায়গায়। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও তিনি এখনো আইন পাস করাতে পারেন। জেডিইউ, টিডিপি, লোক জনশক্তি পার্টির মতো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মিত্রদের ভোট তাঁকে সেই সুযোগ দেয়।
এই বিলের মাধ্যমে মোদি বার্তা দেন যে তিনিই এখনো সংসদ ও দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি। তবে তাঁর এই শক্তি প্রদর্শনের কৌশল বাস্তব সমস্যাগুলো ঢেকে রাখার চেষ্টা হিসেবেই দেখতে হবে।
ভারতের অর্থনীতি বর্তমানে অস্থির। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব বেড়েছে। আদমশুমারি ও নারীদের জন্য সংরক্ষণ বিলের এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। দক্ষিণের দ্রাবিড় দলগুলো বিজেপির হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে। আদালতগুলোও এখন কিছুটা সক্রিয়ভাবে কেন্দ্রের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাকে প্রশ্ন করছেন। যেমন সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি তামিলনাড়ুর রাজ্যপালের আইন পাস আটকে রাখাকে ‘অবৈধ’ বলেছেন।
তা ছাড়া বিজেপি যেসব রাজ্যে জিতেছে, সেখানেও তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের হাল ভালো নয়। মহারাষ্ট্রে ‘লাড়কি ব্যাহেন’ প্রকল্প এখনো কাগজেই রয়ে গেছে।
সব মিলিয়ে মোদির এই রাজনৈতিক প্রতিচিত্র নির্মাণের চেষ্টাগুলো যেন পুরোনো কৌশলেরই আধুনিক পুনরাবৃত্তি; হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব, জাতীয়তাবাদের ঢাকঢোল, বিরোধীদের দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং নিজেকে অদ্বিতীয় হিসেবে জাহির করা। এই পুরো প্রচেষ্টা যেন সেই পুরোনো বার্তাটিকেই আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে চায়—মোদি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। যাকে বলে দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ (টিআইএনএ)।
কিন্তু এই কৌশল কত দিন চলবে? মোদি কি সত্যিই সব প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারবেন? বৈশ্বিক পরিস্থিতি, দেশীয় বাস্তবতা আর তাঁর জনপ্রিয়তার ধস কি শেষ পর্যন্ত আটকে রাখা যাবে?
বিরোধী দলগুলোর বিভাজন মোদিকে সহায়তা করছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্রের জন্য তা আশঙ্কাজনক। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর ‘ইন্ডিয়া’ জোট প্রথম যৌথ বৈঠক করে শক্তিশালী বিরোধী জোট গঠনের ইঙ্গিত দেয়। তখন অনেকে আশা করেছিলেন যে এই মোদিবিরোধী শক্তি এবার নতুন বার্তা নিয়ে আসবে। কিন্তু এরপর তারা আর একবারও একসঙ্গে বসেনি। ব্যতিক্রম শুধু ডিএমকে, যারা দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের অবস্থান বজায় রেখেছে। ওয়াক্ফ বিল নিয়ে প্রতিবাদের সময় কিছুটা ঐক্য দেখা গেছে। কিন্তু সেটা ছিল যেন পরিকল্পনাহীন প্রতিক্রিয়া।
এই ভঙ্গুর বিরোধিতার ফাঁকে মোদি তাঁর পুরোনো কৌশলে আবারও সফল। তিনি বিরোধীদের সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদের বক্তব্যকে ব্যাহত করে দিয়েছেন। অথচ গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য সেই কথাগুলোরই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
তবু বড় প্রশ্ন থেকেই যায়: কত দিন মোদি এই চালগুলো খেলতে পারবেন? কত দিন তিনি দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো থেকে মানুষের চোখ ঘুরিয়ে রাখতে পারবেন?
সময়ের পালাবদলে সেই উত্তরও ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
* অজয় আশীর্বাদ মহাপ্রশস্ত দা ওয়্যারের রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক
- দা ওয়্যার থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
![]() |
| নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি |

No comments