অমিত শাহকে নিয়ন্ত্রণ করুন, মোদীকে অনুরোধ মমতার! টানলেন বাংলাদেশের প্রসঙ্গ, সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’ ঐক্যেরও ডাক -আনন্দবাজারের রিপোর্ট

প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভুয়ো খবর ছড়ানো এবং বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ তুলে অমিত শাহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গে অশান্তির ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ বলেও তোপ দেগেছেন মমতা।

ওয়াকফ ঘিরে অশান্তি এবং মুর্শিদাবাদ পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ইমাম-মোয়াজ্জিমদের সম্মেলনের বক্তৃতার অনেকটা অংশ জুড়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিশানায় ছিলেন অমিত শাহ। শুধু শাহকে নিশানা করাই নয়, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘অনুরোধ’ পর্যন্ত করলেন মমতা।
সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় অশান্তির ঘটনাতেই শাহকে আক্রমণ করেন মমতা। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভুয়ো খবর ছড়ানো এবং বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ তুললেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং শাহকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলেন। পশ্চিমবঙ্গে অশান্তির ঘটনাকে পরিকল্পিত বলেও মনে করছেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণ থেকে বাদ পড়লেন না উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও। কেন্দ্রে বিজেপির দুই শরিক অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী বিহারের নীতীশ কুমারের ভূমিকারও সমালোচনা ছিল মমতার বক্তৃতায়। পাশাপাশি, সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়াকে’ও আরও ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক দিলেন তিনি।

কিসের এত তাড়া?

বাংলাদেশের অশান্তির আবহে এত তাড়াহুড়ো করে কেন ওয়াকফ সংশোধনী বিল আইনে পরিণত করা হল, সেই প্রশ্ন তুললেন মমতা। বুধবার তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানেন না? এত তাড়াহুড়োর কী ছিল? পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া রাজ্য। আপনি ইউনূসের (বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস) সঙ্গে গোপনে মিটিং করছেন, চুক্তি করছেন। করেছেন করুন। তাতে দেশের ভাল হলে আমার কিছু বলার নেই।’’ বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে এপার বাংলাতেও প্রভাব ফেলছে তা মানেন শাসকদলের প্রথম সারির নেতারাও। আরজি কর আন্দোলনে যে বাংলাদেশের নাগরিক আন্দোলনের প্রভাব ছিল, তা-ও মনে করেন তাঁরা। সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেখানেও বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা টানলেন মমতা।

অনুরোধ-আক্রমণ

ওয়াকফ আইন নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে ভুয়ো খবরের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন মমতা। এর আগে রাজ্য পুলিশের তরফেও বার বার এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। মমতার কথায়, ‘‘আমি নাম বলি না। কিন্তু আজকে বলছি। এখানে অমিত শাহের কোম্পানি বেশি আছে।’’ এর পরেই শাহের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘আপনি কোনও দিন প্রধানমন্ত্রী হবেন না। মোদীজির প্রধানমন্ত্রিত্ব গেলে আপনার কী হবে? আপনাকে তো হামাগুড়ি দিতে হবে।’’ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘আমি মোদীজিকে অনুরোধ করছি, ওই লোকটাকে নিয়ন্ত্রণ করুন। একটা লোকের হাতে সব এজেন্সি। যেমন পারছে ব্যবহার করছে।’’

সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে মমতার অনুরোধ, ‘‘এক বছর ধৈর্য ধরুন। দিল্লিতে অনেক পরিবর্তন হবে। নতুন সরকার হলে আশা করি হামাগুড়িবাবু ঢুকবেন না।’’ প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কেও সুর চড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মমতা বলেছেন, ‘‘এখানে এক আর বাইরে এক? দুবাইয়ে গেলে কাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন? সৌদি আরবে গেলে কার সঙ্গে গলা মেলান?’’

যোগী হলেন ‘ভোগী’

বাংলার হিংসা নিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গত দু’তিন ধরে ধারাবাহিক মন্তব্য করেছেন। মঙ্গলবার তাঁর বক্তব্য ছিল, বাংলায় ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে হবে। সেই প্রসঙ্গ টেনে মমতা বলেন, ‘‘যোগী অনেক বড় বড় কথা বলছেন। উনি সবচেয়ে বড় ভোগী। উত্তরপ্রদেশে ৬৯ হাজার শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে, কুম্ভে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই, কথায় কথায় এনকাউন্টার করে দিচ্ছেন, কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না। আর বাংলা নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন।’’

বিঁধলেন বিএসএফ-কে

সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের একটি খবরের প্রসঙ্গ অবতারণা করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘এএনআইয়ের একটা পোস্ট দেখলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলেছে, বাংলার অশান্তির নেপথ্যে বাংলাদেশের লোক আছে। সীমান্ত পাহারা দেয় বিএসএফ, তারা কী করছে?’’ মমতার অভিযোগ, তাঁর কাছে তথ্য রয়েছে, সীমান্ত এলাকায় বাচ্চা ছেলেদের পাঁচ হাজার-ছ’হাজার টাকা দিয়ে বিএসএফ হাতে ইট ধরিয়ে দিচ্ছে। বিএসএফের ভূমিকারও তদন্ত হওয়া উচিত।’’

কংগ্রেসের জায়গায় গন্ডগোল

মুর্শিদাবাদের যে অংশে গোলমাল হয়েছে, সেটি দক্ষিণ মালদহ লোকসভার অন্তর্গত। গত ভোটে যেখানে জিতেছেন কংগ্রেসের ঈশা খান চৌধুরী। বুধবার মমতা বলেন, ‘‘ওটা কংগ্রেসের আসন। জেতার সময়ে জিতবে, আর অশান্তি হলে রাস্তায় বেরোবে না, তা হয় না। তৃণমূলের তিন জন বিধায়কের বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। পার্টি অফিসে হামলা হয়েছে। তৃণমূল এ সবে থাকলে এগুলো হত না। আমরা শান্তি চাই। উস্কানি চাই না।’’

ঐক্যবদ্ধ হোক ‘ইন্ডিয়া’

লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হয়েছিল। ওয়াকফ নিয়ে ‘ইন্ডিয়া’র সব দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ডাক দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘এখন ওয়াকফ করছে, এর পর ইউনিয়ন সিভিল কোড (অভিন্ন দেওয়ানিবিধি) চালু করতে চাইবে। আমি বলব, ‘ইন্ডিয়া’র সব দল এ সবের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ে নামুক।’’

মোদি-ইউনূস বৈঠক নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য মমতার

মুর্শিদাবাদে পাঁচ দিন ধরে চলা দাঙ্গার দায় কেন্দ্রীয় সরকার ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টেনে এনেছেন মোদি-ইউনূসের বৈঠকের প্রসঙ্গ।
বুধবার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ইমাম–মোয়াজ্জিনদের সঙ্গে বৈঠকে মমতা নিজের সরকারের ওপর থেকে এই হিংসার দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। মমতার মতে, ‘এটা প্রি প্ল্যান্ড কমিউনাল রায়ট। বিজেপি বাইরের গুন্ডা নিয়ে এসে গোলমাল করেছে। রামনবমীতে করার পরিকল্পনা ছিল। সেটা করতে পারেনি। তাই এভাবে করেছে। আমি খুঁজে বের করব বিএসএফ কাদের হাত করে এই কাজ করেছে’।

মমতা এদিন বলেন, ‘বাংলাদেশের ইউনূসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী গোপন বৈঠক করতেই পারেন। দেশের ভালো হলে ভালো। কিন্তু আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী? অন্যদেশ থেকে লোক নিয়ে এসে দাঙ্গা করা? আপনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানেন না?’

মুর্শিদাবাদের হিংসার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিএসএফকে দায়ী করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি এএনআই-এর একটি টুইট দেখেছি যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের অনেকে এর সাথে জড়িত। যদি এটি সত্যি হয়, তাহলে এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দায়ী। সীমান্তের দেখাশোনা করে বিএসএফ, রাজ্য সরকার নয়। কেন বিজেপির লোকদের বাইরে থেকে এনে গোলমাল করতে এবং পালিয়ে যেতে দেয়া হল?’

মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, প্ররোচনা দেয়া হয়েছে।

ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে অশান্তির আবহে ইমাম-মোয়াজ্জিনদের বৈঠক থেকে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে শান্ত থাকার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভয় দিয়ে তিনি বলেন, এখানে আমি আছি।

যেহেতু ওয়াকফ সংশোধনী আইন করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, তাই আন্দোলন বাংলা থেকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন মমতা। তার কথায়, আপনারা শান্ত থাকুন। বি কুল অ্যান্ড পিসফুল।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.