৩৬ জুলাইয়ের পর কোন পথে বাংলাদেশ by মু. আবদুল হাকিম

বাংলাদেশের রাজনীতি নামে বহুদলীয় কিন্তু কাজে দ্বিদলীয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র মানে প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র। এখানে জনগণের সবচেয়ে ভালো দল এবং ভালো ইশতেহার বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে। দেশে বাকশালের বদলে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু হলেও মূল দলগুলো বাকশালী  বা কমিউনিস্ট মডেলে তৈরি। দলের   ভেতরে নেতৃত্ব গঠনে গণতন্ত্রকে অনুশীলন করা হয় না।  বড় দলগুলোর কমিউনিস্ট পার্টির মতো নিজস্ব ক্যাডার এবং ছাত্র সংগঠন আছে। বড় বড় দলগুলোর নিজস্ব পেশাজীবী অঙ্গসংগঠন আছে। ছাত্র এবং পেশাজীবী নেতারা নিজেদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা হাসিল করার জন্য দলীয়করণে বেশি উৎসাহী। পেশা স্বার্থ আদায়ে তারা কখনো  তৎপর  নয়। পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে দলগুলোর অবাধ দলীয়করণ ঠেকানোর মতো শক্তিশালী সিভিল সমাজ এদেশে নেই। শক্তিশালী সিভিল সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছার প্রচণ্ড অভাব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে  তীব্র অনীহা বিদ্যমান। ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চর দখলের মতো দেশ দখল হয়ে যায়। দেশের বড় তিনটি দলই তিনটি পরিবারকে কেন্দ্র করে সুসংগঠিত। নেতৃত্বে পরিবার না থাকলে দল ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। শুধু জাতীয় রাজনীতিতে নয়। স্থানীয় সরকার রাজনীতিও পরিবারতান্ত্রিক। গোটা বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতি হাতবদলের মাধ্যমে হাতেগোনা কিছু মানুষের হাতে জিম্মি। কখনো অন্য হাতে হস্তান্তর হয় না। মন্ত্রীর ছেলে মন্ত্রী হয়। এমপি’র ছেলে এমপি হয়। চেয়ারম্যানের ছেলে চেয়ারম্যান হয়। মেম্বারের ছেলে মেম্বার হয়। ব্যতিক্রম খুব সামান্য। কোনো দলের নেতা নির্বাচনে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের কোনো অনুশীলন নেই। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো দলগুলো নীতিভিত্তিক নয়- নেতাভিত্তিক। আবার নীতি থাকলেও তা নেতার হ্যাডমের কাছে নত হয়ে যায়। নেতার পিছে পিছে ঘুরা এদেশের মানুষের নেশা ও পেশা। জনগণ নেতাদের চামচা এবং চাটুকার হয়ে বেঁচে থাকতে চায়। কোনো নীতি ও আদর্শের কথা কল্পনা করার সক্ষমতাও অনেক ভোটারের নেই। নেতাদের চেহারা সুরত এবং কণ্ঠের জাদুতে তারা মুগ্ধ হয় এবং রাজপথে জীবন দান করে। একই মতাদর্শের অনেকগুলো দল থাকে।

ব্রাকেটে ব্যক্তির নাম দেখে এগুলো শনাক্ত করতে হয়। অধিকাংশ দল হচ্ছে ব্যক্তিসর্বস্ব, সাইনবোর্ড সর্বস্ব এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। এগুলো সংসদে একটিও আসন পায় না। তবুও টিকে থাকে। বড় দলগুলো টাকা দিয়ে এগুলো টিকিয়ে রাখে। দলগুলো আর্থিকভাবে সচ্ছলও না। আবার স্বচ্ছও না। দলের গঠনতন্ত্র অনেকটা ফ্যাসিবাদী ধাঁচের। নেতৃত্ব কুক্ষিগত থাকে কয়েকটি ব্যক্তির হাতে। দলীয় কর্মীরা আদার ব্যাপারী হিসেবে দলীয় অফিসে আসে। লুডু ও ক্যারম বোর্ড খেলে এবং টিভি দেখে তাদের সময় কাটে। দলীয় নীতি সম্পর্কে তাদের কিছুই জানানো হয় না। শহীদ হওয়ার প্রয়োজন হলে নেতার নির্দেশে তাদের বলির পাঁঠা হিসেবে রাস্তায় নামানো হয়। কোনো দলীয় সরকার দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে পারবে না। কারণ ছাত্র ক্যাডার ছাড়া তারা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে পারবে না। ছাত্র সংগঠন এবং পেশাজীবী সংগঠন ব্যবহার না করে কোনো রাজনৈতিক দল রাজপথে শোডাউন করতে পারবে না। চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজির সুযোগ না দিলে কোনো ছাত্র আদর্শিক কারণে দলীয় ছাত্ররাজনীতি করবে না। আর্থিক সুযোগ-সুবিধা না দিলে দলে কোনো কর্মী থাকবে না। কোনো রাজনৈতিক দলে দলীয় কর্মীদের জন্য কোনো ক্যারিয়ার পাথ নেই। কর্মীদের নেতা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে শহীদ হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। শহীদের লাশ নিয়ে মিছিল করলেও নেতাদের আসল  ধান্ধা থাকে রাজনীতি করে টাকা কামাই করা এবং বিদেশে টাকা পাচার করা। বড় বড় দলগুলোতে সর্বোচ্চ নেতাকে ঈশ্বরের মতো ভক্তি করা হয়। এজন্য বড় বড় দলগুলোতে সচেতন সমর্থকের চেয়ে অন্ধ সমর্থক বেশি। তারা নেতাদের উচ্চাভিলাষ পূরণে বলির পাঁঠা হিসেবে কাজ করে এবং তাতেই তারা নিজেদের  জীবনকে ধন্য মনে করে। বলির পাঁঠাদের মুখে বার বার শহীদ বললেও শহীদী মর্যাদা দিয়ে তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়  ত্রিশ লাখ শহীদের কোনো তালিকা দেশের কোথাও সংরক্ষিত নেই।

দুই লাখ বীরাঙ্গনার তালিকা নেই। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্ভুল কোনো তালিকা নেই। রাজাকারদের নির্ভুল কোনো তালিকা নেই। ফলে যাকে খুশি তাকে কায়দা মতো রাজাকার বলে ঘায়েল করা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল কোনো তালিকা এখনো তৈরি করা  হয়নি যাতে কিয়ামত পর্যন্ত নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা বানানোর রাস্তাটা খোলা থাকে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও  নির্ভুল কোনো তালিকা নেই। এজন্য নেতাদের ডাকে রাজপথে জনগণ সহজে নামতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, প্রভোস্ট ইত্যাদি হওয়ার জন্য দলবাজি করেন। আইনজীবীরা জিপি, পিপি,  অ্যাটর্নি এবং হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার জন্য দলবাজি করেন। পুলিশ ও আমলারা বড় বড় পদে যাবার জন্য নেতার পদলেহন এবং দলবাজি করেন। এমন কি সেনা অফিসারগণও বিগত পনেরো বছরে দলবাজি থেকে মুক্ত ছিলেন না। আমলারা মন্ত্রিপরিষদ  সচিব, মুখ্য সচিব, সচিব, সাংবিধানিক পদ এবং ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য দলবাজি করেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দলীয় কোটায় পদোন্নতি পাবার জন্যই এত দলীয়করণ এবং দলবাজি। এজন্যই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জন্ম হয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের। এজন্য প্রায় সকল পেশাজীবী অনেক নিচে নামতেও মানসিকভাবে প্রস্তুত। দলীয় সরকারের হাত ধরেই স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে রাজনীতি ধীরে ধীরে দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে। ফলশ্রুতিস্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বর্তমান এই  বিষবৃক্ষ। গ্যাং পলিটিক্সকে নলেজ পলিটিক্সে রূপান্তর মোটেই সহজ কোনো বিষয় নয়।  সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অধিকারভিত্তিক রাজনীতির চর্চা বা অনুশীলন না থাকায় এদেশের মানুষ গণতন্ত্রের কোনো স্বাদ পায় না। কোথাও কোনো দুর্নীতি বা সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলে সবার নজর পড়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি  ও তার নৈতিক চরিত্রের উপর। ঐ ব্যক্তিকে ভালো করে ধর্মগ্রন্থ পড়ালে এমনটি ঘটতো না বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন। এ দেশের সংবিধান ও আইনগুলোকে জ্ঞানপাপীরা এমন ভাবে প্রচার করে যাতে আমজনতা মনে করে এগুলো আসমানী কিতাব। এগুলোতে কোনো ভুল বা দোষ নেই। যত ভুল বা দোষ সব মানুষের চরিত্রে। মানুষের চরিত্র ঠিকঠাক হয়ে গেলে রাষ্ট্র বা সমাজ সংস্কারের আর কোনো প্রয়োজন হবে না। টকশোতে সংস্কারের কথা যারা বলে তাদেরকে আমেরিকার দালাল বলে দিনরাত গালিগালাজ করা হয়।  আইনের ঘাটতিটা সবার নজর এড়িয়ে যায়। আইনকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী মহলের অভ্যুদয় সম্পর্কে তারা বেখবর। বুদ্ধিজীবীদের ফোকাসটা এখানেই দরকার সবচেয়ে বেশি। এ দেশের মতো সুবিধাবাদী এবং ভীতু বুদ্ধিজীবী পৃথিবীতে বিরল। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছিল দয়াল বাবা কিবলার কাবার আয়নাঘরের আয়নাবাজি এবং গুমের ভয়।  এদেশে প্রধানমন্ত্রীর পদটি মাফিয়া ডনের মতো একটি পদ। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে মাফিয়া ডনের মতো পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ- পদোন্নতি দেন। এই ক্ষমতা দিয়ে তিনি প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং সাংবাদিকদের আজ্ঞাবহ ক্রীতদাস বানান। এদের মাধ্যমে তিনি ৫ বছরের ক্ষমতাকে বিনাভোটে টেনে লম্বা করে ১৫ বছরে নিয়ে যান। 

সাংবিধানিক ঈশ্বরের এ পদটি কোনো দলীয় প্রধানমন্ত্রী সংস্কার করবে না। কোনো দলীয় প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদ সংশোধন করে এমপিদের দ্বারা অপসারিত হতে চান না। সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো থেকে বেশি ফায়দা লুটে রাজনৈতিক দল। শক্তিশালী সিভিল সমাজ না থাকায় জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জিম্মি। সংবিধান সংশোধনে বা রাষ্ট্র সংস্কারে সিভিল সমাজের মতামতকে কখনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে এদেশে বিপ্লব বার বার বেহাত হয়ে যায়। এভাবেই ভারসাম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়। নির্বাচিত সরকারের কাছে সবসময় বিপন্ন নির্বাচন। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এদেশে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে নিরপেক্ষতা এবং সিভিল সমাজের তত্ত্বাবধায়ক শক্তি খর্ব করার জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা করে না। এদেশের  অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমের চোখে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম একটি মার্কিন ষড়যন্ত্র। তাদের এই সংস্কারবিরোধী মনোভাবের ফলে দেশে কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের শিকড় আরও মজবুত হয়। জনগণের ম্যান্ডেট নেই বলে বার বার তারা সিভিল সমাজের রাষ্ট্র সংস্কারের সকল উদ্যোগ ভণ্ডুল করে। জনগণ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায়। বেহাত হয় বিপ্লব। বদলায় না কিছুই। এদেশের  জ্ঞানপাপী বাংলা পণ্ডিত সমপ্রদায় যারা হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ কোথায় হবে  তা জানতে সারা জীবন পার  করে দেন। বিপ্লব কি জিনিস তা তাদের জানার সময় কই? শহীদের সংখ্যা বা আহতের সংখ্যা তাদের কাছে গুরুত্বহীন একটি নামতা মাত্র।  অথচ তারাই  অনেক গবেষণা করে জুলাই বিপ্লবকে জুলাই অভ্যুত্থান বানিয়ে  বিপ্লবকে অর্ধেক ঠাণ্ডা করে ফেলেছে। বাকিটাও হয়তো একদিন একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
সূত্র- জনতার চোখ

mzamin


No comments

Powered by Blogger.